Spread the love

দেবহাটা প্রতিনিধি: সাতক্ষীরা জেলার অন্যতম বিদ্রোহী পুরুষ ছিলেন ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান সরদার। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন দেবহাটার ধোপাডাঙ্গা গ্রামে। তার পিতার নাম গোলাম সাত্তার সরদার ও মাতার নাম জয়নুর নেছা খাতুন।

১৯৩২ সালের ৩০ এপ্রিল জেলার বৈচনা গ্রামে মামার বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ছোট থেকেই লুৎফর রহমান সরদার বেশ ডানপিঠে, সাহসী ও প্রতিবাদী স্বভাবের ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তার বাল্যকালের অধিকাংশ সময় কেটেছে দেবহাটার ধোপাডাঙ্গার পৈত্রিক বাড়ী ও চৌবাড়িয়ায় মামা বাড়ীতে।

ডানপিঠে স্বভাবের কারনে বাড়ী থেকে তাকে পাঠিয়ে দেয়া কালীগঞ্জে ফুফার বাড়ীতে। সেখানকার উত্তর কালিগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন তিনি। পরে সাতক্ষীরা শহরের প্রাননাথ হাইস্কুল (পিএন হাইস্কুল) থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন তিনি।

মাধ্যমিক পড়াশুনার সময়েও তার মধ্যে প্রতিবাদী ভুমিকা পরিলক্ষিত হওয়ায় লুৎফর রহমানকে এলাকার বাইরে অর্থাৎ তৎকালীন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে  পড়াশুনার জন্য ভর্তি করে দেন পরিবার। সেখানে পড়াশুনাকালীন সময়ে ঢাকার কার্জন হলে বক্তৃতায় মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন উর্দু হবে পাকিস্থানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।

মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহর দেয়া ঘোষণার পর ঢাকায় ছাত্র সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিটিং মিছিল শুরু করেন ছাত্রছাত্রীরা। তাদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ছাত্রীরাও।

আন্দোলন ঠেকাতে পাকিস্থান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করলে ২০ ফেব্রুয়ারী রাতে কারফিউ ভঙ্গ করে ছাত্রছাত্রীরা মিছিল বের করলে মিছিলে গুলি বর্ষণ করেন পাকিস্থান সরকারের পুলিশ বাহিনী। পুলিশের গুলিতে অনেকে শহীদ হলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান লুৎফর রহমান সরদার।

ঘটনার পর দিনে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ কলেজের অনেক ছাত্রকে বহিষ্কার করে পাকিস্থান সরকার। ওই ছাত্রদের সাথে লুৎফর রহমানকেও বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কার হওয়ার পর আর লেখাপড়া করা হয়নি তার। পরে ছাত্রছাত্রীদের সাথে সারা পুর্ব পাকিস্থানের সাধারণ মানুষ আন্দোলনে রাজপথে নেমে আসলে ছাত্রজনতার রায় মেনে নিয়ে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি সহ বহাল রাখার সিদ্ধান্ত ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়।

জগন্নাথ কলেজে পড়াশুনাকালীন সময় থেকে বাম রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটলেও ভাষা আন্দোলনের পর পুরোপুরি বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন লুৎফর রহমান। প্রথম থেকেই পুর্ব পাকিস্থান কমিউনিষ্ট পার্টির অন্যতম নেতা কমরেড মনিসিংহ, কমরেড অমল সেন, কমরেড আব্দুর হক, কমরেড তোঁহা খান সহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সাথে বেশ সখ্যতা ছিলো তার।

তাছাড়া লুৎফর রহমানের অন্যতম বন্ধু ছিলেন প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসু। তিনি ১৯৫৪, ১৯৬৫ ও ১৯৭০ সালে স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য বাড়ী থেকে পালিয়ে ভারতের টাকীতে চলে যান। সেসময়ে তার বয়স ছিলো ৪০ বছর। এরমধ্যে তাদের বাড়ীঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। তখন তিন সন্তানকে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন শুরু করেন লুৎফর রহমানের স্ত্রী কারিমুননেছা। একপর্যায়ে তিনিও সন্তানদের নিয়ে চলে যান টাকীতে। সেখানে বন্ধু জ্যোতি বসুর সহায়তায় টাকী ক্যাম্প স্থাপনে ভুমিকা রাখেন লুৎফর রহমান। এমনকি টাকী জমিদার বাড়ীতে লুৎফর রহমানের পরিবার নিয়ে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন বন্ধু জ্যোতি বসু।

টাকীতে ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টারকে সাব সেক্টর কমান্ডার করে ৯নং সেক্টর গঠন ও সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় গুরুত্বপুর্ন অবদান রাখেন তিনি। যুদ্ধ শেষে পাকিস্থানী দালাল ইউনুসকে নৌকার মধ্যে গুলি করে হত্যা করেন তিনি। ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ শেষে নিঃস্ব হয়ে পড়েন লুৎফর রহমানের পরিবার। তাদের অবস্থা দেখে সময়ে খুলনার এসডিও আইভি রহমানের ভাই আজিজুর রহমান তার পরিবারকে এনিমি সম্পত্তি দেয়ার প্রস্তাব দিলে সে প্রস্তাবও প্রত্যাখান করেন লুৎফর রহমান।

দেশের জন্য ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রাখা লুৎফর রহমান সরদার ২০০৭ সালের ১০মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। তবে এমন বিদ্রোহী পুরুষের মৃত্যুর পর তার পরিবারটি আজো অবহেলিত বলে জানিয়েছেন লুৎফর রহমানের ছেলে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের সভাপতি আবু রাহান তিতু।

তিনি বলেন, আমার পিতা দেশের জন্য, ভাষার জন্য, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করলেও আজো তার স্মৃতি সংরক্ষনে সরকারীভাবে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এমনকি তার কবরটি সংরক্ষণের জন্য প্রশাসনের কাছে দাবী জানিয়েও কোন সুরাহা হয়নি। রাষ্ট্রের কাছে তাদের প্রত্যাশা কখনো আলোর মুখ দেখেনি বলেও দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *