Spread the love

দেবহাটা প্রতিনিধি: দেবহাটার দক্ষিণ কুলিয়ায় সরকারী নীতিমালা লংঘন ও প্রজাস্বত্ত্ব আইন উপেক্ষা করে জনবসতিপূর্ণ ফসলী জমিতে বৈধ কোন কাগজপত্র ছাড়াই কেবলমাত্র ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্সের জোরে চলছে মেসার্স এমআর ব্রিকস নামের ইটভাটা।

নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে এবং বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শুধুমাত্র ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নামমাত্র ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে ওই ইটভাটার যাবতীয় কার্যক্রম সম্পুর্ণ অবৈধভাবে চালিয়ে আসছে সদর উপজেলার আলীপুর গ্রামের আব্দুর রশিদ সরদার নামের এক প্রভাবশালী। প্রতিনিয়ত ওই ইট ভাটাটির কালো ধোয়ায় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।

এছাড়া আগুনের লাগামহীন তাপে পুড়ে যাচ্ছে আশপাশের কয়েক হেক্টর জমির ধানক্ষেত, বিস্তীর্ণ ফসল, মৌসুমী সবজির মাঠ ও শতাধিক বিঘা আম বাগানের আমের পাতা ও মুকুলসহ অন্যান্য ফলদ বৃক্ষ। পাশাপাশি ইটভাটার মাটি ও ইট পরিবহনের জন্য ডাম্পার ট্রাক, ট্রলি, মিনি ট্রাক চলাচলের রাস্তা তৈরী করতে কুলিয়ার সাবেক ইউপি সদস্য মোশারফ হোসেনসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের বিস্তীর্ণ সারি সারি আমবাগানের মুকুল ভর্তি ডালপালা রাতের আঁধারে অবৈধভাবে কেটে ধ্বংস করছে ইটভাটা মালিক রশিদসহ তার লোকজন। দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ ধ্বংস করে সম্পূর্ন অবৈধভাবে প্রশাসনের নাকের ডগায় ইটভাটার কার্যক্রম চলে আসলেও ইটভাটাটি বন্ধ কিংবা ভাটা মালিক আব্দুর রশিদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের নীতিমালা লংঘন, প্রজাস্বত্ব ও ভূমি ব্যবহার আইন উপেক্ষা করে এবং ইটভাটা স্থাপনের অনুমোদন ছাড়াই কেবলমাত্র ট্রেড লাইসেন্সের জোরে মোটা টাকার বিনিময়ে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দক্ষিণ কুলিয়ায় সাতক্ষীরা-কালীগঞ্জ মহাসড়ক থেকে মাত্র পাঁচশ গজ দূরত্বের মধ্যেই জনবসতিপুর্ণ ও ফসলী জমির প্রায় ২০ বিঘা জুড়ে গত বছর আগে অবৈধভাবে মেসার্স এমআর ব্রিকস নামের ইটভাটাটি নির্মাণসহ যাবতীয় কার্যক্রম শুরু করেন প্রভাবশালী আব্দুর রশিদ সরদার।

অবৈধভাবে নির্মিত ইটভাটাটি বন্ধের জন্য গত কয়েক বছরে একাধিকবার অভিযোগ জানিয়েও আশানুরুপ কোন ফল পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ স্থানীয় কৃষক ও এলাকাবাসীদের।

সাবেক ইউপি সদস্য মোশারফ হোসেন ছাড়াও ওই এলাকার শফিকুল ইসলাম, আব্দুল্যাহ গাজী, শামছুর রহমানসহ একাধিক বাসিন্দা জানান, ইট ভাটার চারপাশে জুড়ে মাত্র কয়েক গজ দুরত্বের মধ্যেই রয়েছে বিস্তীর্ণ ধানের ক্ষেত ও শীতকালীনসহ মৌসুমী সবজি সহ আমের বাগানসহ নানা প্রজাতির ফলদ বৃক্ষ এবং অন্যান্য ফসলের সমারোহ।

এছাড়া ইটভাটার পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে কয়েকটি গ্রামের বিস্তীর্ণ জনবসতি। এসব এলাকায় জনবসতির পাশাপাশি রয়েছে একাধিক সরকারী, বেসরকারী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদরাসা, মসজিদসহ বহু ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জনবসতিপুর্ণ ও ফসলী জমিতে অবৈধভাবে ওই ইট ভাটাটি স্থাপন ও কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় এলাকার কয়েকশ পরিবার তীব্র হুমকির মুখে পড়েছে।

তাছাড়া ইটভাটা স্থাপনের পর থেকে পাশ্ববর্তী বিপুল পরিমান ফসলী জমির ফসলহানী ঘটে চলেছে। এলাকায় তেমন কোন গাছের পাতা ও ফল থাকছেনা। পুড়ে যাচ্ছে গাছের পাতা। ভাটার ছাইতে ভরে যাচ্ছে ঘর-বাড়ি, রান্নাঘর। জামা-কাপড় মেলা যাচ্ছেনা শুকানোর জন্য। আশেপাশের ফসলি জমির রস ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছে আমের মুকুল, ইরি, বোরো ও আমন ধানের ক্ষেত। শতাধিক বিঘা জমির ধান সহ অন্যান্য ফসল ও সবজির উৎপাদন একবারে কমে গেছে। এতে করে চাষীদের পাশাপাশি তীব্র ক্ষতির শঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন এলাকাবাসীরাও।

এছাড়া ১৯৫১ সালের জমিদারী দখল ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯০ নং ধারা অনুযায়ী সরকারের অনুমতি ছাড়া কৃষি জমি অকৃষি কাজে ব্যবহার বা ব্যবহারের জন্য হস্তান্তর সম্পূর্ণ বে-আইনী হলেও ইট ভাটাটি নির্মাণে জমি হস্তান্তর করা হয়েছে। এই আইন অমান্য করে জমি হস্তান্তর বা ব্যবহার করলে সে জমি বাজেয়াপ্ত করা যেতে পারে। এই আইনের ৭৬ নং ধারা মতে কোন জমি কৃষক ছাড়া অন্য কারও কাছে হস্তান্তর কিংবা বন্দোবস্ত দেওয়া সম্পূর্ণ অবৈধ। এ সকল আইনও মানেননি ভাটা এলাকার জমি ইজারাদাতা ও ভাটা কতৃপক্ষ।

এদিকে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভূমি মন্ত্রালয়ের জারি করা ইটখোলা নির্মাণের জন্য ভূমি ব্যবহার প্রসঙ্গ শীর্ষক সার্কুলারে (স্মারক নং ভূ:ম:/ শ-১০/শু:দ:/ সাধারণ/১৭/১০/৫৭২(৬৪) তারিখ ২৫-৭-১৯৯০ইং) বলা আছে, অনুর্বর কৃষি জমির ওপর ইটের ভাটা তৈরীর প্রস্তাব জেলা প্রশাসকের কাছে দাখিল করতে হবে। জেলা প্রশাসক তদন্ত সাপেক্ষ কেবলমাত্র অনুর্বর অকৃষি জমিতেই ইটের ভাটা স্থাপনের অনুমোদন দেবেন। ভাটা তৈরীর আগে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা ও জেলা প্রশাসকের মধ্যে এ বিষয় চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে।

চুক্তি পত্রে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি শর্ত লিখিত থাকতে হবে। যেমন একটি ইটের ভাটার জন্য দেড় একরের বেশি জমি ব্যবহার করা যাবে না। ইট তৈরীর জন্য একই স্থান থেকে মাটি কাটতে হবে। মাটি কাটার স্থানকে পাড় বিশিষ্ট পুকুরে পরিণত করতে হবে, যেন মাছের চাষ করা যায়। এই শর্ত ভঙ্গ কারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। কিন্তু ভাটার মালিক আব্দুর রশিদ এমন কোন চুক্তি ছাড়াই অবৈধভাবে ভাটাটি স্থাপন করেছেন।

সীমাহীন অভিযোগ ও ইটভাটা পরিচালনার প্রশাসনিক অনুমতি কিংবা বৈধতা সম্পর্কে জানতে চাইলে অদ্যবধি ইটভাটাটির কোন অনুমোদন প্রশাসন দেয়নি স্বীকার করে এমআর ব্রিকসের দেখাশুনার দায়িত্বরত আব্দুল মান্নান বলেন, আমরা বিভিন্ন দপ্তরে ইটভাটা স্থাপনের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছি, তবে এখনো প্রশাসন অনুমতি দেননি। তাহলে বিগত কয়েকবছর প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই অবৈধভাবে ইটভাটাটি কি করে পরিচালনা ও ইট প্রস্তুত করা হচ্ছে সেবিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।

এদিকে প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা এবং সরকারী আইন ও নীতিমালার মুল্যায়ন হিসেবে অবিলম্বে অবৈধ ওই ইটভাটা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা প্রশাসকসহ পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে দাবী জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *