Spread the love

এসভি ডেস্ক: সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় কারাগারে যাওয়ার পরই বেরিয়ে আসছে টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাস ও বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকত আলীর অবাক করা সব তথ্য।

লিয়াকত আলী ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সংস্পর্শে হয়ে ওঠেন ভয়ঙ্কর কিলার। পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েই শুরু তার দুর্বৃত্তপনা। মাত্র দশ বছরে ভয়ানক এক দানবে পরিণত হন এ যুবক। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে (সিএমপি) থাকাকালে তার বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের ধরে এনে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এসআই থেকে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পেয়েই বদলি হন সীমান্তবর্তি টেকনাফে। বন্দুকযুদ্ধের নামে পুরো টেকনাফজুড়ে ওসি প্রদীপের বেপরোয়া খুনের উৎসবে যোগ দেন লিয়াকত। দায়িত্ব পান বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের (আইসি) ইনচার্জের। প্রদীপের কথিত বন্দুকযুদ্ধ আর ক্রসফায়ারের নিরাপদ জোন খ্যাত মেরিনড্রাইভ সড়কের আশপাশে লিয়াকতের গুলিতেও খালি হয়েছে অসংখ্য মায়ের বুক। টেকনাফ থানা এলাকায় সাজানো বন্দুকযুদ্ধের নামে ১৪৪ টি ক্রসফায়ারে ১৬১ জনকে হত্যার মিশন সফল করে এই লিয়াকত।

জানা যায়, কক্সবাজার যাওয়ার পর জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা বিশেষ করে তার প্রতিবেশি প্রদীপের মদদে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে লিয়াকত। জড়িয়ে পড়ে ইয়াবা ব্যবসাসহ নানা অপকর্মে। প্রদীপের সাথে মিলে টেকনাফের ইয়াবা ও মানব পাচারকারীদের টাকা লুট এবং ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় ছিলো তার নেশা। মোটা অংকের টাকা নিয়েও অনেককে দেয়া হয় ক্রসফায়ার। খুনের শিকারদের পরিবারের সদস্যরা এখন মুখ খুলতে শুরু করেছে। একের এর এক বের হয়ে আসছে তাদের নানা কুকর্মের তথ্য।

গত ১৮ জানুয়ারি বাহারছড়া পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ হিসেবে যোগদান করেন লিয়াকত। সেখানে যোগদানের পর ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে মাদক কারবারি নির্মূল অভিযানের নামে অনেক বন্দুকযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন লিয়াকত আলী। সেখানে ছোটখাট ইয়াবা কারবারিসহ কতিপয় নিরীহ মানুষকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নির্দেশে কথিত অনেক বন্দুকযুদ্ধে গুলি চালাতেন লিয়াকত আলী।

শামলাপুর ফিশিং ঘাটের মাছ ব্যবসায়ী নূরুল ইসলাম। দুই মাস আগে পুলিশকে ঘাটের নিয়মিত চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে নির্যাতনের শিকার হন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, শামলাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকত আলী নূরুল গত ২৫ এপ্রিল মানবপাচারের অভিযোগ তুলে নোয়াখালীপাড়া গ্রামের আব্দুল হাকিমের ছেলে আব্দুস সালামকে তুলে আনেন লিয়াকত। পরে ওই পরিবারের কাছ থেকে সাড়ে ৮ লাখ টাকা আদায় করে নেন লিয়াকত। এতে সন্তুষ্ট হতে না পেরে ২৬ এপ্রিল তিনি সালামকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করেন বলে অভিযোগ করেছে পরিবার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানাধীন ইছানগর এলাকায় এক জঙ্গি অভিযানে ১৫ বছরের এক কিশোরসহ তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে হাত পাকা করেন লিয়াকত আলী। ২০১৬ সালে সীতাকুন্ডে এক কথিত জঙ্গি অভিযানে আরো দুজনকে গুলি করে হত্যা করেন লিয়াকত। তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের কিলিং টিমের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবেও তিনি কাজ করতেন বলে জানা গেছে।

সর্বশেষ গত ৩১ জুলাই রাতে মারিষবুনিয়া পাহাড়ে ভিডিওচিত্র ধারণ করে মেরিনড্রাইভ দিয়ে নীলিমা রিসোর্টে ফেরার পথে শামলাপুর চেকপোস্টে মেজর (অব.) সিনহাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। থামার সংকেত পেয়ে দুই হাত উঁচিয়ে প্রাইভেটকারের চালকের আসন থেকে বের হয়ে আসতেই কোন কথাবার্তা ছাড়াই গুলি করেন লিয়াকত। পরপর একাধিক গুলিতে ঝাঝড়া হয়ে যায় সিনহার বুক।

দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টিকারী এই হত্যাকান্ডের কিলিং মিশনের হোতা কে এই লিয়াকত তা নিয়ে দেশব্যাপী এখন নানা সমালোচনা। চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার হাবিলাসদ্বীপ পূর্ব সামারো পাড়ার দরিদ্র পরিবারের সন্তান লিয়াকত আলী। মৃত সাহেব মিয়ার ৬ পুত্রের মধ্যে লিয়াকত আলী সর্বকনিষ্ঠ। বিগত ২০১০ সালে পটিয়ার সরকার দলীয় এমপি শামসুল হকের সুপারিশে পুলিশের এসআই হিসাবে চাকরিতে যোগ দেন তিনি। সিএমপিতে তার কর্মজীবন শুরু।

সিএমপিতে এসআই থাকাকালে বিশেষ করে ডিবিতে দায়িত্ব পালনকালে নানা অজুহাতে ব্যবসায়ীদের তুলে এনে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায়ের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। নগর পুলিশে যোগ দেয়ার পর কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার সাথে সিন্ডিকেট করে নানা অপকর্ম করারও অভিযোগ আছে। তার নির্যাতনের শিকার নগরীর সাগরিকার মেকানিকেল পার্টস তৈরির কারখানা সূচনা এন্টারপ্রাইজের মালিক এসএম জসিম উদ্দিন (৫৫) এখন পঙ্গু প্রায়। লিয়াকতের চাঁদার চাহিদা পূরন করতে না পারায় ১৩টি মামলার আসামি হয়ে তিনি এখন পথে বসেছেন।

জসিম উদ্দিন বলেন, ব্যবসার কাজে চীন সফরের সময় তার প্রতিষ্ঠান থেকে ৭০ লাখ টাকার মালামাল খোয়া যায়। এই ঘটনায় তিনি চারজনকে আসামি করে মামলা করেন। ওই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে লিয়াকত তার কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করেন। তিনি টাকা না দেয়ায় মামলার আসামিদের সাথে মিলে তাকে শেষ করে দেয়া হয়।

এখন তার বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা। তাকে জেলে নেয়া হয়। বিগত ২০১৪ সালের ১৪ জুন তাকে ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে মামলার আসামিদের সাথে আপস করতে চাপ দেন লিয়াকত। তিনি তাতে রাজি না হলে তাকে নির্যাতন করা হয়। এক পর্যায়ে তাকে ক্রসফায়ারের জন্য নিয়ে গেলে তিনি জীবন বাঁচাতে দুই লাখ টাকা তুলে দেন লিয়াকতের হাতে। ওই টাকা নেয়ার পরও তাকে সদরঘাট থানা হাজতে নিয়ে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে চরম নির্যাতন করে ভুয়া একটি পরোয়ানামূলে জেলে পাঠানো হয়।

তিনি বলেন, এতকিছুর পরও ওই মামলায় লিয়াকত আসামিদের বাদ দিয়ে আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দেয়। পরে তিনি তাতে নারাজি দিলে আদালত সিআইডিকে মামলার তদন্তভার দেন এবং সিআইডি ওই চার আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে।

তার ওপর জুলুম নির্যাতনের ঘটনায় অভিযোগ দিয়েও তিনি কোন প্রতিকার পাননি অভিযোগ করে বলেন, সিকিউরিটি সেল থেকে একজন পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি হলেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি।

এমন আরো অনেক ব্যবসায়ীকে তুলে এনে টাকা আদায় করে লিয়াকত। নগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, তার দুর্বৃত্তপনার কথা জানা থাকলেও কেউ ভয়ে তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতো না। কিছু কর্মকর্তার নেক নজর থাকায় সে পার পেয়ে যেতো। এতকিছুর পরও তাকে সোয়াতের মতো বিশেষায়িত টিমের সদস্য করা হয়।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, রাষ্ট্রের পয়সায় তাকে আমেরিকায় নিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিলো অপরাধী নির্মূলের জন্য। কিন্তু তার গুলিতে প্রাণ গেলো সিনহার মতো সম্ভাবনাময় এক যুবকের যে কিনা দেশের জন্য কাজ করছিলো।

সূত্র: পূর্বপশ্চিমবিডি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *