আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।” (সুরা আল-বাকারা: ১৮৩)
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় রমযানের রোজা রাখে, তার পূর্ববর্তী গুনাহ ক্ষমা করা হয়।” (বুখারি: ১৯০১, মুসলিম: ৭৬০)
রমযানের আগমনের পূর্বেই আত্মিক, শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক এবং সামাজিক প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। রমযানের যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সর্বপ্রথম ঈমান মজবুত করা জরুরি। এই মাস তাকওয়া অর্জনের মাস, তাই তাকওয়ার গুণ অর্জনের চেষ্টা করা উচিত। প্রতিদিন কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া, জিকির ও ইস্তেগফারের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। রাসূল (সা.) শাবান মাসে অধিক রোজা রাখতেন এবং দোয়া করতেন, যাতে তিনি রমযানে পৌঁছতে পারেন।
রমযানের জন্য শারীরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। সেহরি ও ইফতারের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ধূমপান ও ক্ষতিকর অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে। রমযানে রাত জাগার ফলে ঘুমের রুটিনে পরিবর্তন আসে, তাই আগেভাগেই ঘুমের সময় ঠিক করা উচিত। রাসূল (সা.) বলেন “শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের চেয়ে উত্তম ও প্রিয়।” (মুসলিম: ২৬৬৪)
রমযানের প্রস্তুতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মানসিক প্রস্তুতি। রোজা শুধু পানাহার ত্যাগের নাম নয়; বরং মন, দৃষ্টি ও জিহ্বার সংযমের নাম। অহেতুক কথা, রাগ, গীবত ও মিথ্যা কথা থেকে বিরত থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। রাসূল (সা.) বলেন “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও অন্যায় কাজ পরিহার না করে, তার পানাহার ত্যাগে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।” (বুখারি: ১৯০৩)
রমযানের ইবাদত সুন্দরভাবে সম্পাদনের জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা করা দরকার। প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াতের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা উচিত। তাহাজ্জুদ, তওবা-ইস্তেগফার ও দরুদ পাঠের জন্য সময় নির্ধারণ করতে হবে। দান-সদকা ও সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করা উচিত। রাসূল (সা.) বলেন “রমযানে এক আয়াত কুরআন তিলাওয়াত করলে অন্য মাসের তুলনায় দ্বিগুণ সওয়াব লাভ হয়।” (তিরমিজি: ২৯১০)
ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি নফল ইবাদত বৃদ্ধির প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। রমযানে তাহাজ্জুদ, নফল নামাজ, তাওবা ও ইস্তেগফার বৃদ্ধি করতে হবে। রাসূল (সা.) বলেন “রমযানে যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় কিয়ামুল লাইল করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ করা হয়।” (বুখারি: ২০০৮, মুসলিম: ৭৫৯)
রমযানে দান-সদকা বৃদ্ধি করা উচিত। রাসূল (সা.) রমযানে সবচেয়ে বেশি দান করতেন। (বুখারি: ৬) তিনি আরও বলেন “একজন রোজাদারকে ইফতার করালে সে রোজাদারের মতোই সওয়াব লাভ করবে।” (তিরমিজি: ৮০৭)
রমযানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য বিশেষভাবে ইবাদত করতে হবে। আল্লাহ বলেন “লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে উত্তম।” (সুরা আল-কদর: ৩) রাসূল (সা.) বলেন “তোমরা লাইলাতুল কদরকে রমযানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে তালাশ করো।” (বুখারি: ২০১৭)
পরিবার ও সমাজের প্রস্তুতিও জরুরি। পরিবারের সদস্যদের রমযানের শিক্ষা দেওয়া এবং ইবাদতের পরিবেশ তৈরি করা উচিত। ইফতার ও সাহরির সময় পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করতে হবে। গরিব-অসহায়দের জন্য খাদ্য ও পোশাকের ব্যবস্থা করা উচিত। রাসূল (সা.) বলেন “তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি সে, যে তার পরিবারের জন্য উত্তম।” (তিরমিজি: ৩৮৯৫)
রমযানে গুনাহ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। গীবত, মিথ্যা, হারাম দৃষ্টি, অপচয় ও অনৈতিক কাজ পরিহার করতে হবে। রাসূল (সা.) বলেন “রমযান হলো এমন মাস, যেখানে মুমিনের রিজিক বৃদ্ধি করা হয়।” (ইবনে খুজাইমা: ১৮৮৭)
রমযানের পরও আমল অব্যাহত রাখতে হবে। রমযানের ইবাদত যেন শুধু এক মাসের জন্য সীমাবদ্ধ না হয়। শাওয়াল মাসে ছয়টি নফল রোজা রাখা উচিত। নিয়মিত কুরআন অধ্যয়ন ও আমল চালিয়ে যেতে হবে। রাসূল (সা.) বলেন “যে ব্যক্তি রমযানের রোজা রাখে এবং পরে শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখে, সে যেন পুরো বছরের রোজা রাখল।” (মুসলিম: ১১৬৪)
রমযান আত্মশুদ্ধির মাস, তাই এ মাসে প্রতিটি মুহূর্ত সঠিকভাবে কাজে লাগানো জরুরি। এজন্য আত্মিক, শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা অপরিহার্য। সঠিক প্রস্তুতি নিলে রমযান আমাদের জীবনে স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম হতে পারে।
লেখক:
মোঃ যোবায়েরুল ইসলাম
প্রভাষক, সাতক্ষীরা আলিয়া কামিল মাদ্রাসা।
Email: iszobayr@gmail.com