Spread the love

রাবিদ মাহমুদ চঞ্চল: প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী মান্না দে’র একটা অত্যন্ত জনপ্রিয় গানের প্রথম কয়েকটি কলি খুব করে মনে পড়ছে। মিষ্টি একটা গন্ধ রয়েছে ঘরটা জুড়ে,কেউ না জানি এসে কাউকে না পেয়ে গেছে কি ঘুরে? আজ এতক্ষনে এই গানটি মনে পড়ার বিশেষ একটা কারণও রয়েছে। আমাদের ছোটবেলায় বর্ষা মৌসুম চারিদিকে নদীতে যখন পানি থৈ থৈ করতো,সেই সময় জেলেরা তাদের জাল-দড়ি নিয়ে ছুটে যেত নদীতে। তাদের জালে ধরা দিতো ঝাকে ঝাকে রুপালি ইলিশ। হাট বাজার থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জের পথে প্রান্তরে ফেরি করে ইলিশ বেচা-বিক্রির একটা চীরচরিত দৃশ্য আমাদের চোখে পড়তো। শহর কিংবা গ্রামের প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই এই সময় ইলিশের একটা মৌ মৌ গন্ধ থাকতো। ইলিশের মিষ্টি একটা গন্ধ থাকতো ঘর জুড়ে। অল্প বিস্তর যাইহোক দু-এক টুকরা ইলিশ পাতে পড়তো সবার। কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেল সেই দিনগুলো। সামাজিক অর্থনীতিতে মানুষের আয় বেড়েছে,জীবন যাত্রার মান ও বেড়েছে। কিন্তু আজকাল মানুষ আগের দিনের মতো ইলিশের সে স্বাদ-গন্ধ থেকে একপ্রকার বঞ্চিতই হচ্ছে। হবেই না বা কেন? ১৬০০ থেকে ২০০০/- যদি ১ কেজি ইলিশের দাম হয় তাহলে কি মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আছে? আগের তুলনায় এখন ইলিশ উৎপাদন বা আহরণ কয়েক গুন বেড়েছে,কিন্তু কেন সাধারণ মানুষ আগের মত ইলিশ খেতে পারে না?
গত কয়েকদিন আগে জাতীয় দৈনিক বণিক বার্তায় ইলিশ নিয়ে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ খবরে বলা হচ্ছে, গত এক যুগে বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হলেও বাজারে সরবরাহ বেড়ে এর দাম কমেনি। বরং একই সময়ে উৎপাদনের মতো দামও বেড়ে হয়েছে কয়েক গুণ। আর সেই সাথে সাধারণ মধ্যবিত্তের টেবিল থেকে বিদায় নিয়েছে ইলিশ। মাছটির ওপর এখন একচেটিয়া অধিকার তৈরি হয়েছে অভিজাতদের। অথচ একসময় সাধারণ মধ্যবিত্তের পাতে ছিল ইলিশের নিত্য আনাগোনা। একেবারে নিম্নবিত্তেরও নাগালের বাইরে ছিল না ইলিশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইলিশের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি কিছুটা শ্লথ হয়ে এসেছে। একই সঙ্গে মাছটি হয়ে উঠেছে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কূটনীতির হাতিয়ার। ভারতে ইলিশ রফতানি করা হবে না—দায়িত্ব গ্রহণের পর এমন সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু অল্প কিছু দিন যেতেই সরকার সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। আসন্ন দুর্গা পূজা উপলক্ষে ভারতে তিন হাজার টন ইলিশ রফতানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রফতানি হয়েছিল প্রায় ৬৬৫ টন। যা এবারে বেড়ে চার গুণ ছাড়িয়েছে। দুই দেশের কূটনীতিতে ইলিশকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হলেও তা থেকে কোনো দেশের সাধারণ মানুষের খুব একটা উপকার হয় না বলে বলা হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে।
বিবিসির তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট মাছ উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশই ইলিশ। দেশের জিডিপিতে এটি প্রায় ১ শতাংশ অবদান রাখে। বাংলাদেশের জেলেরা বছরে ৬ লাখ টন ইলিশ ধরেন।জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৭৬ টন ইলিশ ভারতে রফতানি হয়। এরপরের ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৯৯ টন ইলিশ রফতানি হয়। অন্যদিকে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ২৩০ টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৯১ টন ইলিশ রফতানি হয়। সবশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮০২ টন ইলিশ ভারতে রফতানি হয়। গত ৫ বছরে মাত্র ৫ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ রফতানি হয় ভারতে।
আগে ইলিশ সাধারণ রফতানি পণ্যের তালিকায় উন্মুক্ত থাকলেও, উৎপাদন সংকট দেখিয়ে ২০১২ সালে দেশের বাইরে ইলিশ রফতানি বন্ধ করে দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তবে ২০১৯ সাল থেকে বিশেষ বিবেচনায় কেবল দুর্গাপূজাতে আবারও ইলিশ রফতানির সুযোগ দেয় আওয়ামী লীগ সরকার।
২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আসে অন্তবর্তীকালীন সরকার। এরমধ্যেই ভারতের ব্যবসায়ীরা দুর্গাপূজায় ইলিশ আমদানির অনুরোধ জানান। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে দেশের চাহিদা মিটিয়ে পরে বিদেশে ইলিশ রফতানি হবে জানিয়েছিলেন বর্তমান সরকার। কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে দেড় মাসের মাথায় ভারতে ইলিশ রফতানির অনুমতি দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু রফতানি বন্ধ করতে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী। এত কিছুর পরেও সব বাধা কাটিয়ে শুরু হয়েছে ইলিশ রফতানি। ২৬ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) ভারতে ঢুকেছে ইলিশ। গত বছর ইলিশ রফতানির অনুমতি ছিল ৩ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন। রফতানি হয়েছিল মাত্র ৬৬৩ মেট্রিক টন। এবছর বৃহত্তর স্বার্থে ভারতে ইলিশ রফতানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে জানান অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ২৬ সেপ্টেম্বর দুপুর ২ টার দিকে কাস্টমস ও বন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বেনাপোল বন্দর দিয়ে প্রথম ৪টি চালানে ৪ ট্রাকে ১২ মেট্রিক টন ইলিশ ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে প্রবেশ করে। দেশের ৪৯ জন রফতানিকারককে ২ হাজার ৪২০ টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। শর্ত দেয়া হয়েছে আগামী ১৩ অক্টোবরের মধ্যে শেষ করতে হবে রফতানি। প্রতি কেজি ইলিশের রফতানি মূল্য ১০ ইউএস ডলার যা বাংলাদেশি টাকায় ১ হাজার ১৮০ টাকা। 
এক্ষনে প্রশ্ন হলো হলো ইলিশ যখন ভারতে রপ্তানি হবে না। আমাদের দেশের মানুষ খাবে বলে বাহ বাহ কুড়লেন তখন ইলিশের দাম কমলো না। কমপক্ষে দেড় হাজার থেকে শুরু করে প্রায় দুই হাজার ছুঁই ছুঁই অবস্থা (জাটকা বাদে) তখন সবাই মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলেন। আর সেই একই সাইজের ইলিশ যখন ভারতে পাঠালেন তখন মূল্য নির্ধারণ হলো ১১৮০ টাকা। কিন্তু কেন? এমন প্রশ্ন বোধ করি আমার মত এখন কোটি জনতার। অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলছেন- বৃহত্তর স্বার্থে ইলিশ রপ্তানি করা হচ্ছে। তাই যদি হয় তাহলে এই বৃহত্তর স্বার্থ কি? সেটা জনগণের সামনে স্পষ্ট করুন। যেদিন ইলিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলো সেদিনই ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশেরদের উদ্দেশ্যে উল্টো করে ঝুলিয়ে পেটানোর কথা বললেন। তাহলে কি আমরা ধরে নেব পিটানি খাওয়া ভয়ে আমরা ভারতকে ইলিশ দিচ্ছি। আবারও কি ভারতের সাথে নতজানু পররাষ্ট্র নীতিতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। দয়া করে স্পষ্ট করুন। আর তা যদি ‘না’ ই হয় তাহলে নিশ্চয়ই কোন অর্থনৈতিক কারণ আছে, ইলিশ পাঠানোর মাধ্যমে ভারত থেকে আমরা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ আর আয় করতে পারব কি? তাও যদি না হয় তাহলে বৃহত্তর স্বার্থটা কি? প্রকৃতপক্ষে যদি অর্থ আয় করার উদ্দেশ্য থাকে তাহলে প্রবাসী বাংলাদেশীরা বিদেশের যে প্রান্তে অবস্থান করছে বা যেসব দেশে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা বেশি এসব দেশগুলোতে কেন ইলিশ রপ্তানি করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। অর্থনীতি যতটুকু বুঝি তাতে পার্শ্ববর্তী ভারতের থেকে ইউরোপীয় দেশগুলোতে ইলিশ রপ্তানি করলে আমরা নিঃসন্দেহে আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব। আমাদের দেশে উৎপাদিত চিংড়ি বা কাকড়া যদি বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে মোটা অংকের রাজস্ব আয় করা সম্ভব হয়, তাহলে ইলিশ বিদেশে রপ্তানির মধ্য দিয়ে আয় করা সম্ভব নয় কি? আর যদি উদ্দেশ্য তা না হয় তাহলে ভারতে ইলিশ পাঠানোর বৃহত্তর উদ্দেশ্য কি সেটা খোলসা করা একান্তই সময়ের দাবি। পরিশেষে মোটাদাগে একটি কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই ইলিশ নিয়ে তামাশা বন্ধ করুন, না হয় ভারতে কেন ইলিশ পাঠানো হলো? বৃহত্তর স্বার্থটা কি, সেটা সুস্পষ্ট করুন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
Email : rabidchanchall@yahoo.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *