নিজস্ব প্রতিনিধি: ‘টানা বর্ষণে ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। এসবের ভিতরে মেয়েটা অসুস্থ। ডাক্তারের কাছে নেওয়ার টাকাও ছিল না। এলাকা থেকে ধার করে যে টাকা পেয়েছি তার বড় একটি অংশ চলে যাচ্ছে পথ ভাড়াতে। ১০ টাকার ভাড়া এখন লাগে ৪০ টাকা। অনেকেতো সুযোগ বুঝে এর চেয়ে বাড়তি ভাড়া দাবি করছে।’
সাতক্ষীরার বেত্রবতী নদীতে একই দিনে ভেঙে যাওয়া ৩ সেতু গত তিন দিনেও সংস্কার করা সম্ভব না হওয়ায় নদী পারাপারে নিজের ভোগান্তির কথা এভাবে বর্ণনা করেন কলারোয়া উপজেলার রেজাউল ইসলাম।
গত বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) দিনের পৃথক সময়ে কলারোয়া উপজেলার পশুর হাট সংলগ্ন বেইলি ব্রিজ, কাঁচা বাজার ও মাছ বাজার সংলগ্ন কাঠ ও বাঁশ দিয়ে নির্মিত সাঁকো ও গোপিনাথপুর তারকনন্দী নামক স্থানের আরেকটি কাঠের বড় সেতু ভাঙার ঘটনা ঘটে।
এতে, কলারোয়া উপজেলা সদর ও পৌর সদরের সাথে পৌরসভার ৩টি ওয়ার্ড ও উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬ ইউনিয়নের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কলারোয়া উপজেলা পরিষদ, কলারোয়া থানা, স্কুল-কলেজ, কলারোয়া পৌরসভা, অফিসসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে আসতে পারছেন না সাধারণ মানুষ। একই সাথে কলারোয়ার সাথে যশোরের কেশবপুর, মনিরামপুর ও ঝিকরগাছা উপজেলা, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার সাথেও আঞ্চলিক সড়কের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন ওইসমস্ত এলাকার ৭ লাখ মানুষ।
রেজাউল বলেন, নদী জুড়ে সবটাই কচুরিপানানে ভরা। নদী খননের কাজ চলছে গড়িমসি৷ তারউপর দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারনে ঠিকাদার সময় মত ব্রিজ নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেননি। সবমিলিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের গড়িমসির কারনে এ সমস্যা পোহাতে হচ্ছে তার মতো লাখও মানুষকে বলে জানান তিনি।
স্থানীয়দের দাবি, গত কয়েকবছর ধরে নদী খনন কাজ চললেও নদী পরিচ্ছন্নতা না করায় কচুরিপানার চাপে বর্ষার পানি সরতে না পারায় এ ব্রিজ ভাঙার ঘটনা ঘটে। এখানে সঠিক জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। যার কারনে এঘটনা ঘটেছে বলে জানান তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, কলারোয়া পৌরশহরে অবস্থিত বেত্রবতী বেইলি ব্রিজের পূর্বপাশ দেবে গিয়ে নদীর সঙ্গে মিশে গেছে। লোহার ওই বেইলি ব্রিজের পূর্বপাশের ওপর দিয়ে ৩-৪ ফুট উচ্চতায় পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে।
এ অবস্থায় নদী পারাপারে স্থানীয় জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীরা সেচ্ছাশ্রমে নদীতে জমে থাকা কচুরিপানা জমাটবদ্ধ করে তারা পায়ে হাঁটার পথ তৈরি করেন। বর্তমানে শ্যাওলার সংকীর্ণ পথ দিয়ে হেঁটে সারিবদ্ধভাবে মানুষ নদী পার হচ্ছেন। তবে সবধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
অপরদিকে, কলারোয়ার কাঁচা বাজার ও মাছ বাজার সংলগ্ন কাঠ ও বাঁশ দিয়ে নির্মিত সাঁকো ও গোপিনাথপুর তারকনন্দী নামক স্থানে ভেঙে যাওয়া কাঠের বড় সেতুর স্থলে ড্রাম ব্যবহার করে বিকল্প একটি ভাসমান বিকল্প সেতু স্থাপন করার কাজ চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গেল কয়েক বছর আগে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় কলারোয়া বাজার এলাকায় বেত্রাবতী নদীর ওপরের সেতুটি নতুন করে নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৪৮ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ দশমিক ২৫ মিটার প্রস্থের সেতুটি নির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয় ৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। কাজটি পায় মোজাহার এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ২০২১ সালের ১৪ এপ্রিল সেতু নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কাজটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর। সময় শেষ হওয়ার পরও কাজ শেষ হয়নি।
সময়তো ঠিকাদার কাজ শেষ করতে না পারায় স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামীলীগের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের দোষারোপ করেন সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মমতাজুল ইসলাম চন্দন।
চন্দন বলেন, ভেঙে যাওয়া তিনটি ব্রিজের ভিতরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজ পশুর হাটের ব্রিজটি। এই ব্রিজ দিয়ে প্রতিদিন লাখো মানুষ যাতায়াত করে।
২০২১ সালে ব্রিজটি নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সেটা ঠিকাদারের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি।
কারন হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের চাঁদাবাজির কারনে ঠিকাদার কাজ করতে পারেননি। তাদের দাবিকৃত চাঁদার টাকা দিলে বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হতেন তিনি। এজন্য দীর্ঘ আটমাস ব্রিজটির নির্মাণ কাজ বন্ধ ছিল। পরে আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর তিনি পুণরায় ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন।
চন্দন আরও বলেন, চলমান নদীখননেও হরিলুট হয়েছে। সেখানে কোন স্বচ্ছতা ছিল না। যেনতেন ভাবে কাজ চলছে। তারউপর পৌর কর্তৃপক্ষ নদী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে কোন উদ্যোগ নেয়নি৷ এরফলে নদীতে কচুরিপানার উপস্থিতি বেড়ে যায়। আর বর্ষার মৌসুমে নদীতে পানি বৃদ্ধি হলে কচুরিপানার চাপে এই ব্রিজ গুলো ধসে ও ভেঙে যায়।
যদিও এব্যাপারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মোজাহার এন্টারপ্রাইজের মালিক মোজাহার আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
কলারোয়া পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম জানান, বেত্রবতীর ক্ষতিগ্রস্ত দুটি কাঠের সাঁকো সংস্কারের জন্য তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন। এজন্য প্রাক্কলিত মূল্য নির্ধারণের কাজ চলছে। সবকিছু ঠিকঠাক হলে শিগগিরই তারা সাঁকো দুটি সংস্কারের কাজে হাত দেবেন।
সাতক্ষীরা সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার পারভেজ জানান, ভেঙে যাওয়া বেইলি ব্রিজের পাশে আরেকটি লোহার বেইলি ব্রিজ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে মাগুরা থেকে সরঞ্জামাদি ট্র্যাকযোগে এসেছে। আগামী কয়েকদিনের ভিতরে বেইলি ব্রিজের নির্মাণ কাজ শেষ হবে।