Spread the love

মুনসুর রহমান: করোনা পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ ঘরে অবস্থান করলেও তাদের কাছে সংবাদ পৌছে দিতে ঝুঁকির মধ্যে সংবাদ সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত সাতক্ষীরার প্রায় ৫ হাজার সংবাদকর্মী।

জানা যায়, ষাটের দশকে সাতক্ষীরায় পত্রিকা প্রকাশের সূচনা হলেও তথ্য প্রযুক্তির যুগে বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সকল আন্দোলন সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি অনলাইন নিউজ পোর্টালের যাত্রা শুরু হয়। এরপরে সাতক্ষীরায় প্রিন্ট পত্রিকার পাশাপাশি অনলাইন নিউজ পোর্টাল বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। ফলে সাতক্ষীরায় নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা ৯ টি, সাপ্তাহিক ৪ টি ও প্রায় শতাধিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল সংবাদ পরিবেশন করছে। তবে এসব পত্রিকার প্রায় ৫ হাজার সংবাদকর্মী করোনার এই মাহাদূর্যোগের সময়কালে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এমনকি সাতক্ষীরার টেলিভিশন সাংবাদদাতারাও এর বাইরে নয়। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সংবাদকর্মী বলেন, করোনা সংক্রমণে আক্রান্ত জেলা থেকে প্রতিদিন শত শত ইটভাটার শ্রমিক ও অন্যান্য ব্যক্তিরা প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সাতক্ষীরায় প্রবেশ করছেন। জেলার সংবাদকর্মীরা এ সব সংবাদসহ বিভিন্ন সংবাদ সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হওয়ায় প্রায় ৫ হাজার সংবাদকর্মী করোনা ঝুঁকিতে রয়েছেন। এখনই তাদের চলাচলে বিধি নিষেধ আরোপ করতে না পারলে ভয়াবহ রুপ ধারণ করবে বলে ধারণা করছেন সচেতন মহল।

আনুমানিক হিসাব…

সাতক্ষীরা শহরে সংবাদপত্র বিপননকারী আলাউদ্দীন বলেন, গ্রাহকরা এখন চরম আতঙ্কে আছে। পত্রিকার মাধ্যমে করোনা ছড়াতে পারে এমন আশঙ্কায় আপতত পত্রিকা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন অনেক গ্রাহক। পরিস্থিতি ভালো হলে আবার পত্রিকা নেবেন বলে জানিয়েছেন তারা। আর এমন পরিস্থিতিতেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেশ কিছু জাতীয় পত্রিকা আর স্থানীয় পত্রিকা মানুষের কাছে পৌছে দিচ্ছি।

সাবেক খুলনা বিভাগীয় সিনিয়র রোভার মেট প্রতিনিধি নাজমুল হক বলেন, সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জের নাম। সাংবাদিকদের প্রতিটা দিন, প্রতিটা সময় এক একটি চ্যালেঞ্জ। আর সেই চ্যালেঞ্জের সাথে যুক্ত হয়েছে করোনা পরিস্থিতি। মফস্বলের টেলিভিশন সাংবাদিকতা আরো কঠিন হচ্ছে পিইপি সংকটের কারণে। বিভিন্ন সময় দুর্যোগেও তাদের পোহাতে হয় নানা দুর্ভোগ। সারাদেশের সাথে কার্যত যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় নতুন করে শুরু হয়েছে আরো কিছু সংকট। বন্ধ হয়েছে কিছু পত্রিকার ছাপার কাজ। পত্রিকাগুলো টিকে থাকে বিজ্ঞাপনের উপর। বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভর করে সংবাদকর্মীদের আর্থিক স্বচ্ছলতা। কিন্তু সেটাও বন্ধ হওয়ায় বর্তমানে আর্থিক সংকটে ভুগছে অধিকাংশ মিডিয়া হাউজগুলো ও তার সংবাদ কর্মীরা। তবে উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে যারা শুধুমাত্র সাংবাদিকতা পেশার সাথে আছেন তাদের অবস্থা আরো নাজুক। তারা না পারছে বলতে-না পারছে সইতে।

তিনি আরও বলেন, জেলা শহরে কর্মরত আছে; বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরা পার্সন। রয়েছে স্থানীয় পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিক। প্রত্যেক পত্রিকায় ২/৩ জন ব্যতীত তেমন সম্মানী দেয়া হয় না। আবার আঞ্চলিক, স্থানীয় ও অনলাইন পত্রিকার রয়েছে উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মরত সাংবাদিক। আমার জানা মতে তাদেরও সম্মানী দেয়া হয় না। তারাও অনেকটা বিজ্ঞাপন নির্ভর। অনেক ক্ষেত্রে কোন অনুষ্ঠান, সভা, সেমিনারে গেলে সামান্য সম্মানীটুকুই তাদের প্রাপ্য হয়। তবে করোনার কারণে মানুষের জনজীবন স্থবির হওয়ায় কিছু সাংবাদিকদের আর্থিক ভিত্তিও স্থবির হয়ে পড়েছে। ভিতরে ভিতরে ক্ষত হলেও থেমে নেই তারা।

সাতক্ষীরা নাগরিক আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি অ্যাড. ফাইমুল হক কিসলু বলেন, বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও সাতক্ষীরার সংবাদকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহের কাজ করছে। কিন্তু তাদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কোনো পিপিইও কোনো কোনো সংবাদকর্মীর কাছে দেখা যাচ্ছে না। তারা আক্রান্ত হলে সাতক্ষীরায় করোনা ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেজন্য সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের জরুরী ভিক্তিতে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য দাবি করি।

দৈনিক পত্রদূতের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক লায়লা পারভীন সেঁজুতি বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে সাংবাদিকরা বসে নেই। সংবাদকর্মীরা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পাঠানো খবরের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের খবরও প্রকাশ করছেন। বাজার পরিস্থিতি তুলে ধরছেন। এমনকি মানুষের সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরছেন। সংবাদকর্মীদের দেশের তথা বিশ্বের বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে আমাদের সংবাদ তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে। সংবাদ সংগ্রহ করতে চরম ঝুঁকির মধ্যে সাতক্ষীরার সাংবাদিকরা।

তিনি আরও বলেন, সাধারণ মানুষকে ঘরে রেখে বাইরে থেকে সংবাদ সংগ্রহ করতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। কিন্তু তাদের নেই পিপিই। এছাড়া যানবাহন সংকট তো আছেই। সরকারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরী।

চ্যানেল আই এর সাতক্ষীরা প্রতিনিধি আবুল কালাম আজাদ বলেন, করোনা পরিস্থিতির শিকার হয়ে জেলার হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে গৃহে অবস্থান করছেন। সাধারণ মানুষের দু:খ কষ্টের সংবাদটুকুও সংগ্রহ করতে হচ্ছে ঝুঁকি নিয়ে। পিপিই না থাকায় করোনা আক্রান্তের ঝুঁকিতে রয়েছেন সংবাদকর্মীরা। শুধু করোনার সংবাদ নয়, অন্যন্য সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রেও মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে সাংবাদিক সমাজ।

দৈনিক কালের চিত্র পত্রিকার সম্পাদক আবু আহমেদ বলেন, মফস্বলে সাংবাদিকদের সুরক্ষার সংকট অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে। তাই যে (সংবাদমাধ্যম বা গণমাধ্যমের মালিক, সম্পাদক, সংবাদকর্মী, প্রশাসন, রাষ্ট্রযন্ত্র) যার অবস্থান থেকে নিজ দায়িত্ব সততা-নিষ্ঠার সাথে পালন করা জরুরি। তাহলে, করোনার ঝুঁকি থেকে সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব।

সাতক্ষীরা অনলাইন প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হোসাইন বলেন, করোনা ভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ায় চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে সাংবাদিক সমাজ। কারণ সংবাদ সংগ্রহে মাঠে বিচরণই সংবাদকর্মীদের প্রধানতম কাজ। করোনা পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ ঘরবন্দি। ঘরেই থেকেই মানুষ স্যাটেলাইট টিভি ও অনলাইন নিউজ পোর্টালের ওপর নির্ভরশীল। ইতিমধ্যে আমরা জেনেছি বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে কর্মরত কয়েকজন সংবাদকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তারপরও অধিকাংশ সংবাদ কর্মীকে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশেই সংবাদ সংগ্রহের কাজ করতে হচ্ছে এবং হবে। দেশের যে সকল জনগোষ্ঠী চলমান পরিস্থিতিতে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে তাদের মধ্যে সংবাদ কর্মীরা অন্যতম। সেই মহান পেশায় জড়িত কর্মীদের জীবনের নিরাপত্তা তথা স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। সুতরাং, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে সংবাদকর্মীদের জীবনমানের উন্নয়ন ও চলমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য সংবাদকর্মীদের প্রয়োজনীয় পিপিই ও আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।

জেলা সাংবাদিক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব আবুল কাশেম বলেন, পেশাগত কারণেই সাংবাদিকরা সমাজের অনেকের সাথে অপ্রিয় পাত্র হয়েছে। তারা সমাজের নানান অসংগতি তুলে ধরছে, তুলে ধরছে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ সরকারের নানান কর্মকান্ডসহ উন্নয়ন, সমস্যা ও সম্ভাবনা। অনেক জনপ্রতিনিধি, কর্মকর্তার স্বচ্ছ ভাবমুর্তি পত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরছে সাংবাদিকরাই। তাদের পেশা সম্মানজনক হলেও আর্থিক ভিত্তি তলানীতে গেছে। বর্তমানে তাই কিছু সাংবাদিকের এই চরম দু:সময়ে তারা কারো কাছে না পারছে সইতে- না পারছে বলতে। এ ক্ষেত্রে পত্রিকার মালিক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বিত্তশালীরা ভুমিকা রাখতে পারেন। তাদের সাথে যারা সারা দিন পরিশ্রম করে তাদেরকে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরছে; এখন সময় এসেছে সেই সংবাদকর্মীদের পাশে দাঁড়াবার।

তিনি আরও বলেন, সাংবাদিকদের সকল তথ্য জেলার তথ্য অফিসে রয়েছে। রয়েছে জেলায় সাংবাদিকদের একাধিক সংগঠন। তাদের সাথে আলোচনা করে তাদের আর্থিক দুরবস্থা মেটানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তারা বাঁচলে নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের আশা-আকাঙ্খা বাঁচবে। সেজন্য স্থানীয় বিত্তশালী, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনসহ সরকারের প্রণোদনার বিকল্প নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *