নাজমুল শাহাদাৎ (জাকির): করোনা ভাইরাসকে পুঁজি করে ভোক্তাধিকার আইনকে বৃদ্ধা আঙ্গুলি দেখিয়ে বহাল তবিয়তে ব্যবসা করে যাচ্ছে সাতক্ষীরার কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। এতে করে নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষের উপর নেমে আসছে অতিরিক্ত চাপ। এই আইন সম্পর্কে বিস্তারিত না জানার কারণে তেমন একটা সুফল পাইনি জেলার সাধারণ জনগণ। তবে করোনার অযুহাতে ভোক্তা অধিকার আইন অমান্যকারী ব্যবসায়ীদের দমনে মাঠে নেমেছে প্রশাসন। চালানো হচ্ছে অভিযান, আদায় করা হচ্ছে জরিমানা। তবে অধিকাংশ অভিযান শহর কেন্দ্রিক হওয়ায় প্রত্যন্তঞ্চলে বাজার মনিটরিং এর অভাবে অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছামত পণ্য বিক্রয় করছেন। তাছাড়া ওই ব্যবসায়ীরা কোন-না কোন রাজনৈতিক দলের অনুসারী হওয়ায় তাদের এসমস্ত অপর্কমের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায় না স্থানীয়রা।
এদিকে জেলা প্রশাসকের ফেসবুক আইডি থেকে জানা গেছে চলতি মাসে ভোক্তা অধিকার আইনে শতাধিক ব্যবসায়ীকে প্রায় সাড়ে ৬লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় করা হলেও অপরাধ ও অপরাধীর তুলনায় সেটি অনেক কম।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ আইন অনুযায়ী প্রত্যেকটি মুদি দোকানে পন্যের বাজার দর নোটিস বোর্ড টানিয়ে রাখার নিয়ম থাকলেও ভোক্তাদের ফাঁকি দেওয়ার জন্য তা অনেকেই খুলে রেখেছে, আবার অনেক মুদি দোকানি জানেনই না ভোক্তাধিকার সংরক্ষণ আইন কি ? আবার কোন ব্যবসায়ীতো ভূয়া ক্রয় ভাউচার তৈরী করে প্রশাসনকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত! আর একারণে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে সাতক্ষীরাসহ পাশ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষ ।
১৯৬৫ সালের ১৫ই মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসে ভোক্তাদের নিরাপত্তার অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার, পছন্দের অধিকার এবং অভিযোগ প্রদানের অধিকার বিষয়ে বক্তৃতা দেন। যা পরবর্তী সময় ভোক্তা অধিকার আইন নামে পরিচিতি পায়। এরপর ১৯৮৫ সাল থেকে জাতিসংঘ ১৫ মার্চকে ভোক্তা অধিকার দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। বাংলাদেশেও এই দিবস যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়। বাংলাদেশে ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করা হয়। তবে দুঃখের বিষয় আইন প্রণয়নের নয় বছর অতিক্রান্ত হলেও ভোক্তারা এ আইনের সুফল পুরোপুরি ভোগ করতে পারেননি। তাই বন্ধ হয়নি ভেজাল, নকল পণ্য ও ওষুধ বিক্রয়, ওজনে কারচুপি, অতিরিক্ত মূল্য আদায়, মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বিক্রয়সহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। সাতক্ষীরার বাজারগুলোর বেশিরভাগ স্থানে নেই মূল্য তালিকা। কোথাও কোথাও মূল্যে তালিকা থাকলেও দোকানিরা মূল্য তালিকার অবস্থান এমন জায়গায় রেখেছেন যে, ভোক্তারা সহজে তা দেখতে পারেননা। আবার অনেক বাজারে তালিকায় জিনিসের নাম থাকলেও দাম নেই অথবা তালিকার দাম অনুযায়ী বিক্রি হচ্ছে না পণ্যগুলো। অনেক বিক্রেতাই ওজনে কম দেন। এক্ষেত্রে ওজন পরিমাপের যন্ত্রটিতে তারা ত্রুটি করে রাখেন যাতে ভোক্তারা ধরতে না পারেন। এছাড়া শাকসবজি ও ফলমূলে রং ও কেমিক্যাল ব্যবহার নিত্য নৈমেত্তিক ব্যাপার হয়ে গেছে। জেলার সদর উপজেলার বড়বাজার, কলারোয়া মার্কেট, ঝাউডাঙ্গা বাজার, মাধবকাটি বাজার, কদমতলা বাজার, আবাদেরহাট বাজার, ভোমরা বাজার, পরানদহা বাজার, আলিপুর বাজার খোলা, কুলিয়া বাজার, পাটকেলঘাটা বাজার, নলতা বাজার, কালিগঞ্জ, আশাশুনি, শ্যামনগর উপজেলার শহরকেন্দ্রিক বাজার সহ জেলার প্রত্যন্তঞ্চল বাজারের মুদি দোকান, হোটেল , রেস্তোরা ও চাউলের দোকানে নেই কোন বাজার দর নোটিস বোর্ড। পন্যের দাম ওঠা – নামা করলেও দোকানিদের দোকানে পন্যের দাম উর্দ্ধোগতি ছাড়া নিম্নগতির কোন আশাই করা যায় না।
অত্র এলাকার চাষি ও ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন এলাকা থেকে পন্য বা দ্রব্য সাতক্ষীরা সহ পাশ্ববর্তী বাজারে বিক্রয় করে থাকেন। এসময় বিক্রিত মাল একই স্থানে কয়েকবার বেচা -কেনা হয়ে থাকে। আর এক হাত থেকে আরেক হাত পরিবর্তন হলেই, দামও এক হাত বেড়ে যায়। এভাবেই চলছে সাতক্ষীরাসহ পাশ্ববর্তী উপজেলার বিভিন্ন বাজারের বেচা কেনা। এতে করে মালের দাম নিয়ে দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এলাকার সাধারণ মানুষের। সাতক্ষীরা শহরের মাছবাজার, সবজিবাজার, ফলবাজার গুলোই নিয়মিত ফরমালিনযুক্ত মাছ, সবজি ও ফলের বাজারে সাতক্ষীরা জেলা ভোক্তাধিকার কেন্দ্র থেকে মনিটরিং হলেও কিছু দিন যেতে না যেতে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায় বাজারের অসাধু ব্যবসায়ীরা আর শহর অঞ্চলে অভিযান হলেও নিম্ন অঞ্চলের বাজারে তেমন অভিযান হয়না।
আর, এই সুযোগে কিছু অসাদু ব্যবসায়ী নিম্ন অঞ্চলের বাজারে অহরহ বিক্রয় করছে ফরমালিনযুক্ত মাছ, সবজি, ফল সহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্য বলে অভিযোগ ক্রেতাদের। এছাড়া দেশের সব জায়গায় প্রায় একই অবস্থা। বেকারিগুলোয় খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। নষ্ট হওয়া খাবারগুলো বারবার ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া এসব খাবারের গায়ে মূল্য বা উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণ তারিখ নেই। শুধু বেকারির ক্ষেত্রে নয় বরং অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের প্যাকেটজাত খাবারের ক্ষেত্রেও অনেক নিয়ম মানছে না। রেস্টুরেন্টের খাবারের মান ও খাদ্য উৎপাদনের পরিবেশ নিয়েও নানা অভিযোগ আছে ভোক্তাদের। অনেক রেস্টুরেন্টে একদিনের খাবার পরের দিন বিক্রি হচ্ছে। অতিরিক্ত দামের পাশাপাশি ভেজাল খাবার উৎপাদন করছে তারা। অনেক রেস্টুরেন্ট দখল করে আছে ফুটপাত। সুপার মল ও বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ধার্যকৃত মূল্যের অতিরিক্ত মূল্যে পণ্য বিক্রয় করছে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের দাম ও মান নিয়েও প্রশ্ন আছে? আমদানি পণ্যের মূল্য নির্ধারণে নেই বাধা।
শুধু খাবারেই নয়, ওষুধের দোকানগুলোতে বিক্রেতারা খেয়াল খুশিমতো ভোক্তার কাছ হতে টাকা নিচ্ছেন। এন্টিবায়োটিক ঔষধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রয় করা নিষেধ থাকলেও বিক্রয় হচ্ছে অহরহ প্রেসক্রিপশন ছাড়া। এছাড়া ভেজাল বা কম দামি ওষুধ বেশি দামে বিক্রির প্রবণতা তো আছেই। এক্ষেত্রে এগিয়ে ক্লিনিকগুলো। বেশির ভাগ ক্লিনিকে সেবার মূল্য তালিকাও দেখতে পাওয়া যায় না। এছাড়া সেবার নামে রোগীদের হয়রানি, টাকার লোভে অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও ক্ষতিকর ওষুধ প্রদান করছে চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো। ভোক্তা অধিকার আইনে এসব অনিয়মকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। অপরাধভেদে অনূধর্ক্ষ ১০ লাখ টাকা ও সর্বোচ্চ ৫ বছর বা উভয় শাস্তির বিধান আছে। তবে যথাযথ আইন প্রয়োগের অভাবে অপরাধীরা ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। সাতক্ষীরা সহ পাশ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। অধিকাংশ ভোক্তাই নিজের অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞাত। বিক্রেতারাও জানেন না এই আইন ও শাস্তি সম্পর্কে। এ ব্যাপারে সরকারি প্রচারণাও কম। তবে আইন প্রয়োগ শেষ কথা নয়, জনগণের সচেতনতাই এই অধিকার আদায়ে ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক