Spread the love

নাজমুল শাহাদাত জাকির: আজ সেই ভয়াল ২৮ ফেব্রুয়ারি। ২০১৩ সালের  জামায়াত শিবিরের সহিংসতায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, সাংবাদিকসহ কমপক্ষে ৫০ জন জখম হয়। হত্যা করা হয় সাতক্ষীরা সিটি কলেজের প্রভাষক ও সিটি কলেজ ছাত্রলীগের তৎকালিন সভাপতি এবিএম মামুন হোসেনসহ ১৭ জন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীকে ।

ওইদিন জেলাজুড়ে প্রায় শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এঘটনায় সাতক্ষীরা সদর থানা পুলিশ বাদী হয়ে তৎকালিন জেলা জামায়াতের আমীর যুদ্ধাপরাধী মামলার আসামী অধ্যক্ষ খালেক মন্ডল, যুগ্ন-সম্পাদক জেনারেল আজিজুর রহমান, জামায়াতের প্রচার সম্পাদক ও দৈনিক আলোর পরশের তৎকালিন সম্পাদক আলতাফ হোসাইন, সদর উপজেলা জামায়াতের আমীর রফিকুল ইসলাম, সদর পশ্চিম থানা আমীর মাওলানা শাহাদাৎ হোসেন, কাশেমপুর হাজামপাড়া জামে সমজিদের ইমাম মোহাম্মদ আলী, কাশেমপুর গ্রামের মাওলানা ঈমান আলী, ফিংড়ীর হাবিবুর রহমানসহ ১৯০জন আসামীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। তবে মামুন হত্যার সাত বছর অতিক্রম হলেও আজও মামুন হত্যার বিচার শেষ না হওয়ায় সীমাহীন ক্ষোভ ও হতাশ হয়েছেন তার পরিবারের সদস্যরা।

মামুনের সহোদর মাসুম হোসেন বলেন, আমার ভাই হত্যার সাতবছর অতিবাহিত হলেও এখনো বিচার কাজ সম্পন্ন হয়নি। আমি আমার ভাইকে হারিয়েছি। ভাই হারানোর কষ্ট আমি বুঝি। প্রথম কয়েক বছর প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই আমাদের অবস্থার খোঁজ খবর নিতেন। সময় গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে এখন আর কেউ খোঁজ খবরও রাখেন না। 
কান্না জাড়িত কণ্ঠে তিনি আরো বলেন, আমার বাবা গুরুত্বর অসুস্থ্য। ছেলে হত্যাকারীদের বিচার দেখে যাওয়ার আশায় থাকেন তিনি আর মাঝে মাঝে তিনি মামলার বিষয়টিও খোঁজ নেন।

জামায়াত-শিবিরের হাতে নির্মমভাবে নিহত মামুন হত্যার দ্রুত বিচার দাবি করে জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বলেন, ২০১৩ সালের ২৮ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা মাওঃ দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর রক্তাক্ত হয়ে উঠে সাতক্ষীরা। ঘোষণা দিয়েই সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা। রায় ঘোষণার পর বিকালে সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি প্রভাষক এবিএম মামুনকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যার মধ্য দিয়ে সাতক্ষীরা জেলায় শুরু হয় জামায়াত শিবিরের তান্ডবলীলা। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় মামুনের ঘরবাড়ি। বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে দৌড় দিয়ে পালানোর চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। 

তারা আরো বলেন, মামুনসহ একে একে ১৭জন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে কখনো রাতের আধাঁরে নির্মমভাবে হত্যা করে জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা। শতাধিক হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর করে পুড়িয়ে দেয়। এই ঘটনার ৭ বছর পার হলেও হত্যা মিশনে জড়িত উল্লেখযোগ্য কোন আসামীকে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে পারেনি পুলিশ। দীর্ঘ সময়েও ২০১৩ সালের তান্ডবলীলায় জামায়াত-শিবিরের হাতে নির্মমভাবে নিহত ছাত্রলীগ নেতা মামুনসহ ১৭জন দলীয় নেতাকর্মীর বিচার কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় জেলার নেতাদের দোষারোপ করেছেন তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।

তারা বলেন, ১৩ পরবর্তী ইউপি নির্বাচন, পৌর নির্বাচন, জেলা পরিষদ নির্বাচন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাতক্ষীরায় দলীয় নেতাদের ভিতরে বিভেদ সৃষ্টি হয়। আর এ কারনে, নিজেদের পাল্লাভারি করতে তারা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৭জন দলীয় নেতাকর্মী হত্যাকান্ড মামলার আসামীদের কৌশলে আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থক করে নেন। এতে করে প্রশাসন আসামীদের গ্রেপ্তার করলেও নেতাদের সুপারিশে ছাড়া পেয়ে যান তারা। এতেকরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলেও ওই সমস্ত আওয়ামী লীগ নেতা হত্যাকান্ড মামলার বিচার কাজ এখনো সম্পন্ন হয়নি।

ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জানান, ২০১৭ সালে জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা আশা করেছিলাম নতুন কমিটির মাধ্যমে আন্দোলন সংগ্রাম দিয়ে হলেও মামুন হত্যাকান্ডে জড়িত সকল আসামীদের আইনের আওতায় আনবো। তবে জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় তারা মামুন হত্যা মামলার আসামী ও তাদের সন্তানদের প্রকাশ্যে মদদ দিতে দেখা যায়। এতে করে মামুন হত্যা মামলার বিচার কাজ সেভাবে এগিয়ে যায়নি।

সাতক্ষীরা সিটি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা ও সদর থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ-সম্পাদক হাসানুজ্জামান শাওন বলেন, ২০১৩ সাল থেকে অদ্যাবধি দীর্ঘ সাত বছর অতিবাহিত হলেও সিটি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা প্রভাষক মামুন হত্যার বিচার কাজ শেষ না হওয়া আমাদের জন্য দুঃখজনক। আমরা দ্রুত ছাত্রলীগ নেতা মামুন হত্যা মামলায় জড়িত সকলকে আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচার কাজ সম্পন্ন করার জোড় দাবি করছি।

সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু বলেন, ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর জেলা জুড়ে জামায়াত শিবিরের তান্ডব শুরু হয়। শহরতলীর বকচরা মোড়ে পুলিশ ও বিজিবির ধাওয়া খেয়ে কদমতলার দিকে ফেরার পথে কয়েকজন জামায়াত শিবিরের নেতা-কর্মী প্রথমে মামুনের বাড়িতে প্রবেশ করে মামুনকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে মুড়ি ও পানি খেতে চায়। পরে ওরা জামায়াত-শিবিরের কয়েকশ নেতা-কর্মীকে ডেকে এনে ছাত্রলীগ করার অপরাধে মামুনকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। এক পর্যায়ে তারা মামুনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস ও বাবা শহীদুল ইসলামসহ তার ছোট বোনকে মারপিট করে ঘরের নীচের তলার দরজায় তালা মেরে ঘরে পেট্রোল ঢেলে ও গান পাউডার ছড়িয়ে আগুণ ধরিয়ে দেয়।

তিনি আরো বলেন, ২০১৩ সাল থেকে অদ্যাবধি জামাত-শিবিরের হাতে নিহত সকল দলীয় নেতাকর্মীদের হত্যা মামলার বিচার কাজ দ্রুত শেষকরার জন্যে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে যতদ্রুত সম্ভব মামুন হত্যার বিচার কাজ সম্পন্ন করা হবে। 

সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ-সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, জামায়াত শিবিরের সহিংসতায় ছাত্রলীগ নেতা মামুন হত্যাকান্ডের পর তার পরিবারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তাজনিত কারণে কেউ মামলা করতে সাহস পায়নি। পরে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তৎকালিন সাতক্ষীরা সদর থানার উপ-পরিদর্শক শরিফুল ইসলাম বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ১৯০ জনের নাম উল্লেখসহ ১০/১২ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। এঘটনায় পুলিশ কিছু আসামীদের গ্রেপ্তার করলেও দ্রুত বিচারকাজ শেষ না হওয়ায় আমরাও হতাশ হয়েছি।

সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, হত্যা মামলার অধিকাংশ আসামিদের বাড়ি ভারত সীমান্ত এলাকায়। পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনা করা মাত্রই তারা সীমান্ত পার হয়ে ভারতের ভূখন্ডে আশ্রয় নেয়। ইতোমধ্যে গোয়েন্দা সূত্রে মামুন হত্যা মামলার অনেক আসামীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বাকি আসামিদের আটক করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *