Spread the love

আব্দুর রহমান(রাসেল): বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সাতক্ষীরা জেলার ঘোনা গ্রামে বাস করতো গরীব কৃষক আব্দুল গফ্ফার সরদার। গরীব কৃষকের ছোট্ট মেয়ে জামিলা খাতুন, পড়াশোনায় খুবই ভালো। সে ৫ম ও ৮ম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়েছে। যখন সে ৮ম শ্রেণিতে বৃত্তি পেল সবাই খুব খুশি। কিন্তুু তার গরীব মূূর্খ বাবা লেখাপড়ার কিছুই বোঝেনা।মেয়েকে সে বিয়ে দিতে চায়।কিন্তু মেয়ে লেখাপড়া করে ডাক্তার হতে চায়।

অনেক কষ্ট করে জামিলা বিভিন্ন মানুষের আর্থিক সহায়তায় নবম শ্রেণীতে ভর্তি হলো।যথারীতি ক্লাস চলতে থাকলো।এর মধ্যে তার বাবা বিদেশে থাকা এক মাঝ বয়সি লোকের সাথে তার বিয়ে ঠিক করলো।ছেলে পক্ষ তাকে দেখতে আসবে আসবে করছে। এক দিন স্কুলে ক্লাস চলাকালিন সময়ে তার ছোট বোন সাগরিকা তাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে যেতে আসলো।সে বুঝতে পারলো তার বিয়ের ব্যাপারে ছেলে পক্ষ তাকে দেখতে এসেছে। সে স্কুল থেকে বাড়িতে যেতে রাজি হলোনা এবং খুব কান্নাকাটি শুরু করলো।তার শিক্ষক এবং সহপাঠীদের কাছে সাহায্য চাইলো তারা যেন তার বাবা-মাকে বুঝিয়ে তার বিয়ে থামিয়ে দেয়।কারণ সে আরও পড়াশোনা করতে চায়। পড়াশোনা করে বড় হয়ে ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে চায়। কিন্তু সেইদিন কেউই তার পাশে দাঁড়ালো না।

স্কুল ছুটি হয়ে গেল। সবাই যে যার বাড়িতে চলে গেল কিন্তু জামিলা খাতুন স্কুলের বারান্দায় বসে কান্নাকাটি করছিল। সন্ধ্যা হয়ে গেল কিন্তু কেউই তাকে সাহায্য করতে এলো না। অবশেষে তার বাবা এসে তাকে বাড়িতে নিয়ে গেল এবং ঐ রাতেই বিদেশ থাকা ঐ ব্যাক্তির সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিল।বিয়ের তিন মাসের পর জামিলা খাতুনের স্বামী বিদেশ চলে গেল।তখন জামিলা দুই মাসের গর্ভবতী। জামিলা খাতুন লেখাপড়া বন্ধ করে অনেক কষ্টে তার বাবার বাড়িতে বসবাস করতে লাগলো। বিদেশ যাওয়ার কিছু দিন পর তার স্বামী যোগাযোগ কমিয়ে দিল। মাঝেমধ্যে ফোন করলেও দেয় না কোনো টাকা পয়সা। হঠাৎ করে এক দিন জামিলার স্বামী তার ছোট ভাইকে বিদেশ নিয়ে যাওয়ার কথা বলে জামিলার বাবার কাছে দুই লক্ষ টাকা যৌতুক দাবি করলো।

এই কথা শুনে দরিদ্র কৃষক গফ্ফার সরদারের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। কোথায় পাবে সে এত টাকা।অতি কষ্ট করে পঞ্চাশ হাজার টাকা জোগাড় করে দিল জামিলার স্বামীর কাছে। কিন্তু টাকার পরিমাণ কম হওয়ার কারণে সে খুব গালাগালি দিতে লাগলো এবং জামিলা খাতুনকে তালাক দেওয়ার হুমকি দিল।এর মধ্যেই জামিলা খাতুনের কোলে এলো একটি ফুটপফুটে কন্যা সন্তান। মেয়ে হয়েছে শুনে জামিলার স্বামী তাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিল।

জামিলা খাতুনের বাবা এই কথা শুনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। তারপর জামিলা দের সংসারে নমে এলো করুন দূরগতি।কীভাবে চলবে সংসার এবং কীভাবেই চালাবে জামিলার শিশুর ভরণপোষণ ও চিকিৎসা। আগেই সম্পদ যা ছিল তা বিক্রি করে সব টাকা তুলে দিয়েছিল জামিলার নিষ্ঠুর স্বামীর হাতে। কোনো উপায় না পেয়ে জামিলা মানুষের বাসায় ঝিয়ের কাজ করতে শুরু করলো ছোট্ট মেয়ের খাদ্য ও চিকিৎসার কথা ভেবে। দিন যায় আর জামিলাদের সংসারে অভাব বাড়াতে থাকে। একইসাথে বাড়তে থাকে জামিলার প্রতি পাড়াপ্রতিবেশির লোলুপ দৃষ্টি ও অত্যাচার।

অবশেষে জামিলাকে আবার বিয়ে দেওয়া হলো মাঝ বয়সী এক ব্যবসায়ীর সাথে। নতুন সংসারে বাচ্চাসহ ভালোই কাটচ্ছিল জামিলার দিনকাল।কিন্তু বিধিবাম। রোড দূর্ঘটনায় দুই পা হারালো জামিলার নতুন স্বামী। আবারও জামিলার সংসারে নেমে এলো করুন পরিণতি। এরই মধ্যে আরও একটি পুত্র সন্তান হয়েছে জামিলার। তার এখন বড় সংসার। সব মিলিয়ে চারজন সদস্য সংসারে। স্বামী কিছুই করতে পারে না।খুব কষ্টে কাটতে লাগলো জামিলার দিন। কি করবে সে ভেবে পায়না। অগত্যা সে আবারও মানুষের বাসায় কাজ করতে শুরু করলো।

কষ্ট করে কোনো ভাবে কাটছিলো তাদের দিনকাল।এরই মধ্যে গ্রামে দেখা দিল ভয়াবহ বন্যা। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। একই সাথে চারিদিকে অভাব ও রোগব্যাধি বাড়তে থাকলো। জামিলার ছোট্ট বাচ্চারাও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলো। কিছুদিন পর বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য গ্রামে এক দল ডক্তার এলো। জামিলা ছোট্ট বাচ্চাদের নিয়ে লাইনে দাঁড়ালো ঐ ডাক্তারকদের চিকিৎসা নেওয়ার জন্য। অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর যখন তার চিকিৎসা নেওয়ার পালা এলো তখন সে দেখতে পেল চিকিৎসা সেবা দিতে আসা ডাক্তার গুলো তার ছোটবেলার স্কুলের বন্ধুরা।

যারা ছিল জামিলার চেয়ে খারাপ ছাত্র। কিন্তু তারা পড়ালেখা করে আজ বড় বড় ডাক্তার হয়েছে। জামিলা ঔষধ না নিয়ে ফিরে যাচ্ছিল। তখন ঐ ডাক্তাররা বললো আপনি ঔষধ না নিয়ে চলে যাচ্ছেন কেন? তখন জামিলা বললো আমি তোমাদের সেই স্কুলের বন্ধু জামিলা। যে এক সময় ছিল তোমাদের চেয়ে ভালো ছাত্রী। সে আজ মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালায়। ঐ দিন যদি তোমরা আমার বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে এবং আমি লেখাপড়া সুযোগ পেতাম তাহলে আমিও আজ ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা দিতে পারতাম। তোমাদের মত। আমার জীবনের এই করুন পরিণতির জন্য তোমরাও দায়ী।

আমার দ্বিতীয় স্বামী রোড দূর্ঘটনায় দুই পা হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে আর আমি মানুষের বাসায় কাজ করে সংসার চালাই। এই কথা শুনে তার বন্ধুরা খুবই কষ্ট পেল। সবাই মিলে টাকা দিয়ে তার পঙ্গু স্বামীকে একটি মুদীর দোকান তুলে দিল এবং তার বাচ্চাদের পড়াশোনার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিল।অবশেষে তারা প্রতিজ্ঞা করলো আজ থেকে আর কোনো জামিলা যেন বাল্য বিবাহের শিকার না হয় এবং সমাজে যেন বাল্য বিবাহ না হয়। আমরা সবাই চাই বাল্য বিবাহ মুক্ত সমাজ। এটাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।