উজ্জ্বল রায়, নড়াইল প্রতিনিধি: নড়াইলের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী গোলাম আশরাফ (খোকন) এর ভাগ্যে জীবদ্দশায় মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি জোটেনি।
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েও কোনো স্বীকৃতি ছাড়াই তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তাঁর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং গার্ড অব অনার ছাড়াই চির নিদ্রায় শায়িত হন তিনি।
বিগত ২০১৬ সালের ২০ জুলাই সকালে নারায়ণগঞ্জে ভাড়া বাসায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নড়াইল জেলার সদর উপজেলাধীন ভদ্রবিলা ইউনিয়নের পলাইডাঙ্গা গ্রামের মৃত কাজী আঃ মজিদের ছেলে তিনি। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১ সালের রণাঙ্গনে না হারলেও দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে হেরে গিয়েছিলেন। বিগত ২০১৬ সালে ২০ জুলাই জোহর বাদ তাঁকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সরকারি কবরস্থানে দাফন করা হয়। তিনি স্ত্রী, তিন মেয়ে, এক ছেলে ও নাতী-নাতনী রেখে গেছেন।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, নড়াইল সদর, নড়াইল এর কমান্ডার এস.এ বাকী জানান, মৃত কাজী গোলাম আশরাফ (খোকন) বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সৈনিক। তিনি ৮নং সেক্টরে স্বাধীনতা যুদ্ধে বি.এল.এফ হিসাবে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নড়াইল সদর থানা কমান্ডার শরীফ হুমায়ুন কবীরের সাথে বাংলাদেশে আসেন ও নড়াইল অঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি নড়াইল যুদ্ধে অংশ নিয়ে সবার সাথে নড়াইল মুক্ত করেন। এরপর তিনি ঢাকাতে বঙ্গবন্ধুর নিকট মুজিব বাহিনীর সাথে অস্ত্র জমা দেন।
এস.এ বাকীর মতে, মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাসে তিনি যে কাজগুলো করেন, তা একটি গ্রন্থ হওয়ার দাবি রাখে। তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁকে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়ার সময় অনেকে অবাক হন তাঁকে গার্ড অব অনার না দেওয়ায়। আসলে তাঁরা জানতেন না এই মুক্তিযোদ্ধা সরকারি তালিকায় নেই। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অন্তর্ভুক্তির জন্য তাঁর স্ত্রী আবেদনে অংশগ্রহণ করেন।
এ সময় অনলাইনে আবেদন বন্ধ থাকায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পি.এ মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান নাজিরের মাধ্যমে হাতে লেখা আবেদনপত্র জমা দেন তিনি। এ সময় বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা, যেমন শরীফ হুমায়ুন কবীর, এস.এম ফজলুর রহমান, কাজী আঃ হামিদ, শরীফ বাদশাহ মিয়া তাঁদের লিখিত প্রত্যয়ন পত্রে মৃত কাজী গোলাম আশরাফ (খোকন) কে একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা এবং একাত্তরের রণাঙ্গনে তাঁকে একজন অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে আখ্যায়িত করে সাক্ষ্য দিলেও এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকাভুক্ত করা হয়নি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শরীফ হুমায়ুন কবীর তাঁর প্রদত্ত প্রত্যয়নপত্রে লিখেন, ‘কাজী গোলাম আশরাফ (খোকন) ১৯৭১ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের টান্ডুয়া ক্যাম্পে বি.এল.এফ (মুজিব বাহিনী) প্রশিক্ষণ নিয়ে আমার সাথে বাংলাদেশে আসেন এবং নড়াইল অঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে নড়াইল পানি উন্নয়ন বোর্ডে অবস্থিত পাক-হানাদার ও রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি বীরত্বের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং কৃতিত্বের সঙ্গে বিজয়ী হন। এ যুদ্ধে রেঞ্জার এবং রাজাকার বাহিনীর অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। বাকিরা আত্মসমর্পণ করেন।
পরে তিনি ঢাকাতে বঙ্গবন্ধুর নিকট মুজিব বাহিনীর সাথে অস্ত্র জমা দেন।’ মুক্তিযোদ্ধা কাজী আঃ হামিদ, শরীফ বাদশাহ মিয়া, এস.এম ফজলুর রহমান তাঁদের প্রদত্ত প্রত্যয়ন পত্রে লিখেন, ‘কাজী গোলাম আশরাফ (খোকন) একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তিনি আমাদের সহযোদ্ধা ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নড়াইলের বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয়ভাবে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
এছাড়াও তিনি ১৯৭১ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের টান্ডুরা ক্যাম্পে বি.এল.এফ (মুজিব বাহিনী) কর্তৃক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মুক্তিযোদ্ধা আক্ষেপের সাথে বলেন, ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার ছড়াছড়িতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাও মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়। তেমনই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী গোলাম আশরাফ (খোকন)।
তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। এই বীর যোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই দাফন করা হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান না জানানোর খবর শুনে আমরা বিস্মিত হয়েছি। কেন এমন হলো! চতুর্দিকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার ছড়াছড়ি, অথচ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তালিকা থেকে বাদ পড়ছে, রাষ্ট্রীয় সম্মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই লজ্জা রাখি কোথায়?’
২০১৪ সালে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে নড়াইলের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেয় ফেসবুক ফ্রেন্ডস অব নড়াইল (এফএফএন) নামে একটি সামাজিক সংগঠন। এ সময় এফএফএন কর্তৃপক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আশরাফ খোকনকেও সংবর্ধনা দেন। ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁর হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী এ.কে.এম মোজাম্মেল হক।
এছাড়াও স্বামীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে কাজী গোলাম আশরাফ (খোকন) এর স্ত্রী মনোয়ারা বেগম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করানোর জন্য নড়াইলের জেলা প্রশাসক বরাবরও আবেদন করেন।
এতকিছু সত্তেও অদ্যাবধি মৃত কাজী গোলাম আশরাফ (খোকন) এর ভাগ্যে জোটেনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। বর্তমানে তাঁর স্ত্রী-সন্তানেরা বিভিন্ন জনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য। এছাড়াও মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। মৃত কাজী গোলাম আশরাফ (খোকন) এর অসুস্থ স্ত্রী মনোয়ারা বেগম তাঁর স্বামীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।