পীর হাবিবুর রহমান: দুই সপ্তাহের লন্ডন-নিউইয়র্ক সফর শেষে রবিবার সকালে ঢাকায় ফিরেছি। শনিবার সন্ধ্যায় হিথ্রো বিমাববন্দর থেকে বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে অর্থাৎ বিমানে আকাশে উড়েছি রবিবার সকালে। প্রথমে সিলেট ও পরে ঢাকায় নিরাপদে বিমানযাত্রীদের নামিয়েছে। বিমানের পাইলটদের দক্ষতা, যাত্রাকালে বিমানবালাদের আতিথেয়তা, সমাদর, আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি চোখে পড়ে না। কিন্তু তবু কেন বিমান লোকসানের পাল্লায় চড়ে বুঝতে পারি না! ব্যবস্থাপনা কর্তৃ-পক্ষের খতিয়ে দেখা উচিত যাত্রী ভাড়ার জন্য কী কী করণীয় তা চিহ্নিত করে পদক্ষেপ গ্রহণ।
ঢাকায় নামতে না নামতেই দুঃসংবাদ। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন শ্রমিক সংগঠন ৪৮ ঘণ্টার সড়ক অবরোধের ডাক দিয়েছে। সড়ক পরিবহন আইন সংসদ সংশোধন করায় তারা এ ধর্মঘটের ডাক দিয়ে দেশের মানুষের চরম দুর্ভোগ নিশ্চিত করেছেন। তাই নয়, রাস্তায় যারা গাড়ি নামিয়েছেন, সেসব চালককে কালো পোড়া মবিল মুখে মাখিয়ে দিয়ে বিকারগ্রস্ত মানসিক বর্বরতা ফুটিয়ে তুলেছেন। ছাত্রীর গায়ে কালো পোড়া মবিল ঢেলেছেন। অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত আটকে দিয়ে হাসপাতালগামী অসুস্থ শিশুকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন।
সড়ক পরিবহন আইনের কিছু ধারার তারা সংশোধনী চান। কিন্তু আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আইন সংশোধনের সুযোগ নেই বলার পরও ধর্মঘট অব্যাহত রেখেছেন। বহুল আলোচিত বিতর্কিত নৌপরিবহনমন্ত্রী যেমন মন্ত্রিসভায় বহাল রয়েছেন, তেমনি তার শ্রমিক সংগঠনের পোড়া কালো মবিল সন্ত্রাসীরা সড়কে চরম নৈরাজ্য যখন চালিয়েছে তখন পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে না গিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। বিষয়টি লজ্জাজনকই নয়, তাজ্জব বনে যাওয়ার বিষয়ও। অথচ সরকারের নেতা, মন্ত্রীরা বরাবর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উদ্দেশে বলে আসছেন আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা বা নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে কঠোর হাতে দমন করা হবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের রাস্তায়ই নামতে দিচ্ছে না। বরং যখন-তখন ধরপাকড় ও গায়েবি মামলা চাপিয়ে বাহাদুরের মতো ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু রাস্তায় নেমে কালো পোড়া মবিল সন্ত্রাসীদের হাতে মানুষ বেইজ্জতির শিকার হচ্ছে, দুর্ভোগের মুখে পড়ছে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা কেন নেয়নি, তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন ও কথাবার্তা উঠেছে।
একজন শ্রমিক নেতা-মন্ত্রীর ক্ষমতার দম্ভ গোটা দেশবাসীকে বিস্মিত ও ব্যথিত করেছে। অথচ বেপরোয়া বাসচালকের হাতে কিছুদিন আগে দুই ছাত্রছাত্রীর নিহতের প্রতিবাদে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের যে বিক্ষোভ দেশ উত্তাল করেছিল, রাষ্ট্রকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছিল সব মহলেই তা অভিনন্দিত হয়েছিল। তারা কারও ওপর হামলা করেনি। বন্ধু হারানোর বেদনায় বাসে বাসে আগুন লাগায়নি। শুধু পরিবহন শ্রমিক নয়, দেশের মানুষকেও আইন মেনে চলতে ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শান্তিপূর্ণ পথে সবাইকে আইনের আওতায় চলতে শিক্ষামূলক প্রতিবাদ দেখিয়েছে। তারা অ্যাম্বুলেন্স এলে ছুটে যেতে সহায়তা দিয়েছে।
পরিবহন শ্রমিকরা যদি প্রকৃত প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে লাইসেন্স নিয়ে দক্ষতার সঙ্গে গাড়ি চালান, তাহলে সংসদে পাস হওয়া আইনের সংশোধন নিয়ে ভয় থাকার কথা নয়। তারা যদি পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানোর অসুস্থতায় সড়কে মানুষ হত্যা না করেন তাহলে ভয়ের কিছু নেই। এমনকি তারা যে কোনো দাবি-দাওয়া নিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে আন্দোলন করতেই পারেন, কর্মসূচি দিতেই পারেন। তাই বলে মানুষকে প্রকাশ্য দিবালোকে লাঞ্ছিত অপমান করার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন অ্যাকশনে যায় না, গ্রেফতার করে না তখন অবাক হয়ে দেখতে হয় পুলিশ কেন শাজাহান খানের কালো পোড়া মবিল সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নীরব দর্শক।
রবিবার ঐক্যফ্রন্ট নেতা ও সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তাদের সঙ্গে সংলাপে বসার প্রস্তাব দেন। নিশ্চিত হয়ে ঘুমিয়েছিলাম সরকার প্রতিবারের মতো এবারও সংলাপের আগ্রহ জানিয়ে দেওয়া চিঠি প্রত্যাখ্যান করে বলবে একুশের গ্রেনেড হামলাকারী এবং আগুনসন্ত্রাসীদের সঙ্গে আলোচনা নয়। কিন্তু সোমবার বেলা গড়াতে না গড়াতেই দেখলাম আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংলাপ হবে বলে ঘোষণা দিচ্ছেন। তার আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে কেউ কেউ আপত্তি জানালেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐক্যফ্রন্টের সংলাপে বসার প্রস্তাব দেওয়া চিঠিকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, তিনি আলোচনায় বসবেন। জাতীয় নির্বাচন দোরগোড়ায় রেখে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের বহুল প্রত্যাশিত এই সংলাপ অভিনন্দনযোগ্য। ড. কামাল হোসেন ভোট রাজনীতির ইনিংস সামনে রেখে যে ক্যাচ তুলে দেন তা কঠিন হলেও শেখ হাসিনা দুর্দান্তভাবে লুফে নেন। ফলাফল যাই হোক, বৃহস্পতিবার নৈশভোজের পর দেশ-বিদেশের কাউকে আর বলতে দেবেন না যে, সরকার সংলাপ চায় না। আসলেই রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রীসহ নেতারা বরাবর সংলাপ নাকচ করেছেন গত পাঁচ বছরে বিএনপির। এখন বিএনপি নেত্রী জেলে, নেতা নির্বাসনে ও দন্ডিত। আর বিএনপি ড. কামালের নেতৃত্বে গণভবনে শেখ হাসিনার নৈশভোজ গলাধঃকরণ করবেন। পারেনও শেখ হাসিনা চমক দেখাতে।
বিএনপি দুই বছর ধরে দুয়ারে দুয়ারে সংলাপের জন্য ঘুরেছে। সরকারের সকল পর্যায় থেকে শুরু করে তা নাকচ হয়ে এসেছে। কিন্তু সবাই মনে করেন সব দলের অংশগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যেসব বাধা রয়েছে তা দূর করে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার রাজনীতি একটি উৎসবমুখর ব্যালটের রায় নিশ্চিত করতে পারে। সংসদ ভেঙে দেওয়াসহ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে ঐক্যফ্রন্ট যে সাত দফা দাবি দিয়েছে তা নিয়ে আলোচনার টেবিল থেকে নির্বাচনে গ্রহণযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিত করতে উভয় পক্ষ একটি সমঝোতায় পৌঁছবেন এমনটিই এখন মানুষের আশা।
রাজনৈতিক আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা যদিও বলবেন, অতীতে কখনই কোনো রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত সংলাপ সফল হয়নি। সেখানে আমরা আশা করব, এবারের সংলাপ দুই পক্ষের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করার সমঝোতায় পৌঁছবে। উভয় পক্ষ একগুঁয়ে নীতি পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশার আশানুরূপ ফলাফল দেবেন। উভয় পক্ষ আন্তরিক হলে শেখ হাসিনার অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব। মানুষ যেমন আরেকটি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রত্যাশা করে না, তেমনি নির্বাচন বানচাল বা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে নির্বাচন বানচালের আরেকটি ওয়ান-ইলেভেনও দেখতে চায় না। দুটির অভিজ্ঞতাই গণতন্ত্রপ্রিয় আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষের কাছে সুখকর হয়ে ওঠেনি।
মানুষ চায় সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার মধ্য দিয়ে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। যে নির্বাচনে মানুষ নিঃশঙ্কচিত্তে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট প্রদান করবে এবং সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করবে। নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটদানের আয়োজন করবে এবং এর মধ্য দিয়ে মানুষ একটি শক্তিশালী সরকার ও শক্তিশালী কার্যকর বিরোধী দল তথা জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা এবং তুমুল বিতর্কের প্রাণবন্ত সংসদ ফিরে পাবে। ঐক্যফ্রন্ট যেমন সাত দফা প্রস্তাব উত্থাপন করবে তেমনি সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার তৈরি সংবিধান ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনানুসারে গৃহীত সিদ্ধান্ত তুলে ধরবেন। যুক্তিনির্ভর আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সংলাপ প্রাণবন্ত হোক সেটিই বড় কথা নয়। জাতীয় জীবনে রাজনীতির এই মাহেন্দ্রক্ষণে অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে সংলাপ সাফল্য বয়ে আনুক সেটিই মানুষের প্রত্যাশা।
ঐক্যফ্রন্ট দায়িত্বশীলতার সঙ্গে খোলা মনে আলাপ-আলোচনা করলে এবং সরকার একগুঁয়ে নীতি পরিহার করে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনাকে যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে গেলে কোনো পক্ষই খালি হাতে ফিরবেন না। আর যখন কোনো পক্ষই খালি হাতে ফিরবেন না, তখন শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। সেখানে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ সাহসী ভূমিকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসনের ভূমিকা কী হবে এবং নির্বাচনের পরিবেশ সব দলের জন্য সমান নিশ্চিত করাই বড় হয়ে উঠবে। নির্বাচন সামনে এলে দল ছাড়াছাড়ি, নানা দলে যোগদান, জোট মহাজোট সম্প্রসারণের যে তৎপরতা দেখা দেয় তা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। আগামী কয়েক দিন রাজনীতির এই চাঞ্চল্য আরও বেড়ে যাবে। এটা ভোট রাজনীতির জন্য শুভলক্ষণ ।
সোমবার সরকার যখন সংলাপে সাড়া দিয়েছে, তখন কারাবন্দী চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে আরেক মামলায় সাত বছরের জেল দিয়েছে আদালত। বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন কিনা সে প্রশ্ন থাকলেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডনে নির্বাসিত তারেক রহমান যে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না তা প্রায় নিশ্চিত। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষনেতাদের হত্যা করতে পরিচালিত বর্বরতম ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় তারেক রহমানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। তিনি একা নন, বিএনপি সরকারের একাধিক মন্ত্রী, নেতা, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং হামলার সঙ্গে জড়িত জঙ্গিরা মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবন দন্ডে দন্ডিত হয়েছেন।
নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির জন্য এ রায় যে কত বড় বিপর্যয় তা নেতা-কর্মীরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। সংক্ষিপ্ত লন্ডন সফরকালে সেখানেও তাদের অনুসারীদের ভেঙে যাওয়া মনোবল পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়েছে। আর এটা সত্য, বিএনপি শাসনামলে সংঘটিত সেই লোমহর্ষক রক্তাক্ত একুশে গ্রেনেড হামলার দায় দলটি এড়াতে পারে না। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের মঞ্চ থেকে তাই তারেক রহমান ও সেই মামলায় দন্ডিতদের নিয়ে কোনো বক্তব্য আসেনি। ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ইস্যুতেই এ ঐক্য করেছেন।
লন্ডন-নিউইয়র্ক সফরকালে সময়গুলো একান্ত আড্ডায় আড্ডায় কাটালেও প্রবাসী যার সঙ্গেই দেখা হয়েছে তাদের কাছ থেকে যে দু-তিনটি প্রশ্ন শোনা গেছে তা হচ্ছে, দেশে নির্বাচন হচ্ছে তো? ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে আসছে তো? বিএনপি নির্বাচনে আসছে কিনা? পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা থেকে বলার চেষ্টা করেছি এবার সব দলের অংশগ্রহণে একটি শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে জাতি প্রাণবন্ত জবাবদিহিমূলক সংসদ উপহার পেতে যাচ্ছে। যে যাই বলুন না কেন সরকারের ওপর মহল থেকে প্রার্থী পরিবর্তনের যে আভাস আসছে, আওয়ামী লীগ নিজেদের ঐক্যকে যেভাবে সুসংহত করতে চাচ্ছে কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে আজীবন বহিষ্কারের যে ঘোষণা এসেছে, যেভাবে জনমত জরিপের মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই চলছে তাতে বোঝা যাচ্ছে সরকারি দলও টের পাচ্ছে এবার নির্বাচন হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। এমনকি আওয়ামী লীগ পর্দার অন্তরালে মহাজোট শরিকদেরও আসন ভাগাভাগি যেমন এগিয়ে নিচ্ছে, তেমনি প্রার্থী তালিকাও চূড়ান্ত করছে। অন্যদিকে আদালতের রায়ের পর নির্বাচন কমিশনই একাত্তরে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলই করেনি, বিএনপিও এই দলটির শক্তি সামর্থ্য ও কর্মী বলের মোহ কাটিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ব্যক্তি ড. কামাল হোসেনের ইমেজের কাছে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি জনপ্রিয়তা ভুলে গিয়ে তার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে।
ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন। আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গেলেও কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করুন, দলকে শক্তিশালী করতে নাই পারুন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সংবিধান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে পথ হেঁটেছেন। জনস্বার্থ, মানবাধিকার ও আইনের শাসন নিয়ে আদালতের বারান্দায় দীর্ঘদিন লড়েছেন। আইনজীবী হিসেবে দেশ-বিদেশে তার কতটা সুনাম সে সবার জানা। তার নেতৃত্বে বিএনপিনির্ভর ঐক্যফ্রন্টে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক আ স ম আবদুর রব, সাবেক ডাকসু ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না, সাবেক ডাকসু ভিপি ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, গণস্বাস্থ্যের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যেভাবে মাঠে নেমেছেন তাতে একের পর এক জনসভায় বিএনপি নেতা-কর্মীরাই বেরিয়ে আসছেন না। মানুষের মধ্যেও চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। মাঝখানে যুক্ত হয়েছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন।
মইনুল হোসেনকে কেন ড. কামাল হোসেন ঐক্যফ্রন্টে জায়গা দিলেন সেটি এখনো আমি বুঝতে পারছি না। কারণ ড. কামালসহ তার ঐক্য প্রক্রিয়ায় যারা যুক্ত হয়েছেন, তাদের ব্যাপারে যতটা ইতিবাচক ধারণা আমার ততটা ধারণা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের প্রতি নেই। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব বিকাশের সহযাত্রী তার অগ্রজ সাহসী সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সন্তান হিসেবে বঙ্গবন্ধু তাকে তিয়াত্তর সালের নির্বাচনে এমপি বানিয়েছিলেন। বাকশালের বিরোধিতা করে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে মইনুল হোসেন সাহসিকতার পরিচয় দিলেও পরবর্তীতে ’৭৫ আগস্টের কালরাতে মানবসভ্যতার ইতিহাসে সংঘটিত জঘন্যতম হত্যাকান্ডে খুনিদের অবৈধ রাষ্ট্রপতি হওয়া খন্দকার মোশতাক আহমদের গঠিত রাজনৈতিক দল ডিএলএর এক নম্বর সদস্য হয়ে কলঙ্কিত হননি, সেনাশাসক জিয়ার জেলও খেটেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি চরম আওয়ামী লীগবিদ্বেষী সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষ হিসেবে সবাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা নোংরা মানসিকতা লালন করেছেন। ওয়ান-ইলেভেনের সেনাসমর্থিত সরকারের দাপুটে উপদেষ্টা হিসেবে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের ইজ্জত হরণের চিত্র দেখে উল্লসিত হয়েছেন। এমনকি প্রখর মেধা ও পেশাদারিত্বের মহিমায় তার যে অনুজ তরুণ বয়সে সম্পাদক হিসেবে ইত্তেফাককে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায় নিয়েছিলেন। এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনায় সফল হয়েছিলেন। সেই আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকেও দেশছাড়া করে সুখনিদ্রায় গিয়েছিলেন। ছোট ভাইয়ের অসহায় স্ত্রী, কন্যাদের পাশে দাঁড়ানো দূরে থাক তাদেরও দেশ ছাড়তে হয়েছিল। এ রকম প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং চরম আওয়ামীবিদ্বেষী একজন ব্যক্তিকে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে ড. কামাল হোসেন তার ঐক্যফ্রন্টে কেন নিলেন আমি বুঝতে পারি না। তিনি তো একাত্তরে জল্লাদ ইয়াহিয়া সরকার থেকে ইত্তেফাক পুড়িয়ে দেওয়ার ক্ষতিপূরণও নিয়েছিলেন।
টেলিফোনে আড়িপাতা মানুষের মৌলিক অধিকার পরিপন্থী কিনা দেশের মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও রাজনীতিবিদরা ভালো বলতে পারবেন। তবে তার টেলিফোনে আড়ি পেতে পাওয়া গেছে তিনি ড. কামাল হোসেনের মতো একজন খ্যাতিমান মানুষকেও কাপুরুষ বলতে ছাড়ছেন না। ব্যারিস্টার মইনুলের ক্ষমতার লোভ আছে। রাজনীতির মাঠে নামার সাহস নেই। আজীবন ষড়যন্ত্রের পথ খুঁজেছেন। শেষ পর্যন্ত পচা শামুকে পা কেটে তিনি এখন জেলের ভাত খাচ্ছেন। নিয়তির বিধান হয়তো তার জন্য এভাবেই লেখা হয়েছিল, যেদিন তিনি কাকার রক্তের ওপর দিয়ে খুনি মোশতাকের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
ওয়ান-ইলেভেনে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের ইজ্জত হরণে যিনি উল্লাস করেছিলেন, একগুঁয়ে, দাম্ভিক মইনুল হোসেন শেষ পর্যন্ত টেলিভিশন পর্দায় এক মহিলাকে চরিত্রহীন বলে মানহানির জামিনযোগ্য মামলায় কারাগারে গেলেও এখন তার মুক্তি মিলছে না। তিনি নিজে যেমন রাজনৈতিকভাবে, আদর্শিকভাবে চরিত্রহীন, তেমনি এমন এক মহিলাকে চরিত্রহীন বলেছেন, যার কোনো চরিত্রই নেই।
অপারেশন করে পুরুষ থেকে নারী হওয়া অপরাধ নয়, এটা প্রকৃতির বিষয়। কিন্তু পাকিস্তানের প্রতি দরদ না থাকলে কেউ পাকিস্তানি পুরুষকে কি বিয়ে করতে পারে সেটি বড় প্রশ্ন। পাকিস্তানি স্বামীকে তালাক দেওয়ার পর সেই স্বামীর পদবি নামের সঙ্গে যুক্ত রাখা আত্মমর্যাদা ও স্বচ্ছ চরিত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কিনা এটা একটি বড় প্রশ্ন। যুক্তরাজ্যে অ্যাসাইলাম পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রের গায়ে মৌলবাদের তকমা লাগিয়ে দেওয়া কি একজন দেশপ্রেমিক মানুষের চরিত্র বহন করে এটি একটি বড় প্রশ্ন। ব্যক্তিস্বার্থে উন্নত রাষ্ট্রে বসবাস করার স্বার্থে নিজের দেশে এলে মৌলবাদীরা হত্যা করে ফেলবে এই আবেদনে আশ্রয় প্রার্থনা কি রাষ্ট্রবিরোধিতা নয়? আর এখন দেশে এসে একটি মহলের করুণাশ্রিত হয়ে জীবিকা নির্বাহ ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লোভ কি কোনো সাংবাদিক বা লেখকের চরিত্রের সঙ্গে যায়? তার সম্পর্কে নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে লিখেছেন, প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছেন। লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব ঘিরে বাংলাদেশি সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধই নন, তারা সংখ্যায় অনেক। পেশাদারিত্বের জায়গায় সংগঠিত এবং সমৃদ্ধ। সেখানে এই নারী বাংলা সাপ্তাহিকগুলোতে কম্পোজ করতেন। তিনি তাদের জয় করেছিলেন। সে সম্পর্কে দীর্ঘদিন ভয়েস অব আমেরিকায় কাজ করে অবসর নেওয়া শামীমা আক্তার চৌধুরী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এক স্ট্যাটাসে নির্মোহ সত্য উচ্চারণ করেছেন। ঢাকায় সবাইকে এই চরিত্র নেই অসাংবাদিক নারীর অতীত জেনে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে চিনে নেওয়া উচিত। চরিত্রহীন মানে এরওর শয্যায় যাওয়া বোঝায় না। আদর্শহীনতা, নীতিহীনতা, অসততাই বোঝায়।
এ মুহূর্তে দেশের মানুষ নির্বাচনমুখী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ড. কামাল হোসেনের চিঠির অনুরোধে সংলাপে যখন সাড়া দিয়েছেন, তখন আমরা আশাবাদী এই সংলাপ অর্থবহ হবে। সরকার যেমন উদার মনোভাব দেখাবেন, তেমনি ঐক্যফ্রন্টের নেতা হিসেবে ড. কামাল হোসেন তার আজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে খোলা মনে সংলাপকে সফল করতে ভূমিকা রাখবেন। আমাদের বিশ্বাস কেউ হঠকারী পথ নেবেন না। কোনো পক্ষই একগুঁয়ে নীতি অবলম্বন করবেন না। সংলাপ সংবিধান ও গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখুক। সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দুয়ার খুলে দিক। [সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন]
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন